তুমি ঠিক সময়েই এসেছো, অ্যাথেলস্টেন, বললেন সেড্রিক। স্যাক্সনদের মুক্তি ও স্বাধীনতা পুনরুদ্ধারের যে স্বপ্ন এতদিন আমরা দেখছিলাম তা সার্থক করার এই উপযুক্ত সময়।
সে স্বপ্ন আর আমি দেখি না, সেড্রিক।
এ কথা বলতে তোমার লজ্জা হচ্ছে না? নরম্যান রাজা রিচার্ড এখানে উপস্থিত আছেন, তাকেই জিজ্ঞেস…
রাজা রিচার্ড এখানে!
হ্যাঁ। ঐ তো। যাকে আমরা এতদিন ব্ল্যাক নাইট বলে জেনে এসেছি তিনিই রাজা রিচার্ড। কিন্তু তাঁকে…।
এবারও সেড্রিকের মুখের কথা মুখেই থেকে গেল। অ্যাথেলস্টেন গিয়ে হাঁটু গেড়ে বসেছে রিচার্ডের সামনে।
আমি আপনার কাছে আমার আনুগত্য প্রকাশ করছি, মহানুভব, বললো সে। আজ থেকে মন প্রাণ দিয়ে আপনার আদেশ পালন করাই হবে আমার কর্তব্য।
ইংল্যান্ডের স্বাধীনতার কথাও মন থেকে মুছে ফেলেছে! হতাশ কণ্ঠস্বর সেড্রিকের।
বন্ধু, রাগ করবেন না, মৃদু হেসে অ্যাথেলস্টেন বললো। তিন দিন কফিনের ভেতর থেকে আমার জীবনদর্শন আমূল বদলে গেছে। রাজা হওয়ার বাসনা আর আমার নেই। আমার ছোট গণ্ডির ভেতর নির্বিঘ্নে রাজত্ব করতে পারলেই আমি খুশি।
রোয়েনাকেও তাহলে তুমি চাও না?
অ্যাথেলস্টেন বললো, রোয়েনাকে নিয়ে আপনার বা আমার মাথা ঘামানোর দরকার নেই। ওর মন এখন আইভানহোর দিকে। আমার তাতে খেদ নেই। ঐ তো রোয়েনা, ওকেই জিজ্ঞেস করুন। লজ্জা কি, রোয়েনা? আইভানহোর মতো বীর নাইটকে ভালোবাসো, সে-ও তোমাকে ভালোবাসে, এ তো গৌরবের কথা। আইভানহো, রোয়েনাকে…, কিন্তু কই আইভানহো? একটু আগেই তো এখানে ছিলো!
সারা দুর্গে খোঁজা হলো। কিন্তু কোথাও পাওয়া গেল না আইভানহোকে। দ্বাররক্ষীদের কাছে জিজ্ঞেস করে জানা গেল এক বৃদ্ধ ইহুদী এসেছিলেন আইভানহোর খোঁজে। তার সাথে দুএকটা কথার পরই আইভানহো গার্থকে তার ঘোড়া আনতে বলে। একটু পরেই দুজন বেরিয়ে যায় কনিংসবার্গ দুর্গ ছেড়ে।
চিন্তা কোরো না, রোয়েনা, আগের সেই ঘরটায় ঢুকতে ঢুকতে বললো অ্যাথেলস্টেন। নিশ্চয়ই কোনো জরুরি কাজে গেছে আইভান–আরে কই রোয়েনা? বিচিত্র নারীর মন! কখন এরা কি করে বসে কে জানে? রাজা, টী
কিন্তু কোথায় রিচার্ড? সবার অলক্ষ্যে কখন যে তিনিও বেরিয়ে গেছেন কেউ জানে না।
আইভানহোর মতো তাঁকেও খুঁজে পাওয়া গেল না দুর্গের কোথাও। শুধু জানা গেল, বাইরে এসে সেই ইহুদীকে ডেকে পাঠান তিনি। দুজনের কি কথা হয়। তারপর আর দেরি করেননি রাজা, ঘোড়ায় চেপে দ্রুত বেরিয়ে গেছেন দুর্গ থেকে। বৃদ্ধ ইহুদীও তাঁর সাথে গেছেন।
২২. লোকে লোকারণ্য সেইন্ট জর্জ গির্জা
লোকে লোকারণ্য সেইন্ট জর্জ গির্জার সামনে ফাঁকা জায়গাটা। সবারই চোখ টেম্পলস্টো মঠের প্রধান ফটকের দিকে, কখন সেখান দিয়ে নিয়ে আসা হবে ডাইনী মেয়েটাকে।
সব কিছু তৈরি। গ্র্যান্ডমাস্টারের জন্যে বিশেষ একটি আসনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। তার দুপাশে প্রধান যাজক ও বিশিষ্ট নাইট টেম্পলারদের আসন। লড়াইয়ের জন্যে নির্ধারিত জায়গার এক কোণে একটা দণ্ডকে ঘিরে স্তূপ করে সাজানো হয়েছে কাঠ। রেবেকাকে শিকল দিয়ে বাঁধা হবে ঐ দণ্ডে। তারপর গ্র্যান্ডমাস্টারের একটা ইঙ্গিতের কেবল অপেক্ষা, আগুন জ্বালিয়ে দেয়া হবে কাঠের স্তূপে। এভাবেই পুড়িয়ে মারা হয় ডাইনীদের।
অবশেষে বেজে উঠলো টেম্পলস্টো মঠের ঘণ্টা। তারপর বাজতেই থাকলো ধীর লয়ে, দর্শকদের মনে বিষণ্ণ এক অনুভূতি জাগিয়ে। ফটক পেরিয়ে এগিয়ে এলেন গ্র্যান্ডমাস্টার। ছোটখাটো একটা মিছিলও এগিয়ে আসছে তার সাথে সাথে। মিছিলের একেবারে সামনে পতাকা হাতে একজন টেম্পলার। তার পেছনে পাশাপাশি দুজন নাইট, প্রধান পুরোহিত, শেষে গ্র্যান্ডমাস্টার। আরো পেছনে নাইট টেম্পলার ব্রায়ান দ্য বোয়াগিলবার্ট। মুখ ফ্যাকাসে, চোখ গর্তে ঢুকে গেছে, দেখে মনে হয় কয়েক রাত ঘুম হয়নি।
সদলবলে আসন গ্রহণ করলেন গ্র্যান্ডমাস্টার। থেমে গেল ঘণ্টাধ্বনি!
নিয়ে এসো আসামীকে, আদেশ করলেন গ্র্যান্ডমাস্টার।
কয়েক জন রক্ষী নিয়ে এলো রেবেকাকে। আশ্চর্য শান্ত তার মুখ। দুশ্চিন্তা বা ভয়ের চিহ্ন মাত্র নেই। শ্বেত শুভ্র পোশাক পরনে। ধীর ভঙ্গিতে হেঁটে আসছে। কাঠের স্তূপের সামনে রাখা একটা কালো আসনের কাছে নিয়ে যাওয়া হলো তাকে। কাঠের তৃপটা দেখলো নিরাসক্ত দৃষ্টিতে। মুহূর্তের জন্য একবার ভয় ফুটে উঠেই মিলিয়ে গেল তার চোখ থেকে। মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে আসনটায় বসলো রেবেকা। দর্শকদের দিকে একবার তাকিয়ে চোখ বুজলো। মৃদু মৃদু কাঁপছে ঠোঁট দুটো। বোধহয় প্রার্থনা করছে রেবেকা।
গ্র্যান্ডমাস্টারের ইঙ্গিতে একজন ঘোষক এগিয়ে এসে ঘোষণা করলো, বিচারসভার কাজ শুরু হচেছ!
প্রথমে আজকের বিচারসভার ধরন সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত ভাষণ দিলেন গ্র্যান্ডমাস্টার। তারপর তাকালেন প্রধান যাজক ম্যালভয়সিঁর দিকে। ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালেন ম্যালভয়সিঁ। টেম্পলার ব্রায়ানের দিকে তাকালেন।
আমি তৈরি, ব্রায়ান বললো।
গ্র্যান্ডমাস্টারের দিকে ফিরলেন প্রধান যাজক। বললেন, মঠের পক্ষ হয়ে লড়বার জন্যে প্রস্তুত টেম্পলার ব্রায়ান দ্য বোয়া-গিলবার্ট।
তাহলে শুরু হোক লড়াই, বললেন গ্র্যান্ডমাস্টার।
বেজে উঠলো ট্রাম্পেট। থেমে গেল আবার। ঘোষক এগিয়ে এসে ঘোষণা করলো লড়াইয়ের নিয়ম কানুন। তারপর আবার বেজে উঠলো ট্রাম্পেট। থামলো। লড়াইয়ের জায়গায় গিয়ে দাঁড়ালো ব্রায়ান। কিন্তু রেবেকার পক্ষ থেকে কোনো নাইট এগিয়ে এলো না।