আমি তো পুরোপুরি ভালো হয়ে গেছি, মহানুভব, বললো আইভানহো।
তাহলে চলো কনিংসবার্গে। আজই তোমার বাবার সাথে দেখা করবো আমি। কিন্তু তার আগে কিছু খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা করতে হয় যে, রবিনহুড। এতক্ষণ লড়াই করে শুধু ক্লান্তই হইনি, খিদেও পেয়েছে।
নিশ্চয়ই, মহানুভব। কিছুক্ষণ সময় দিন আমাকে।
একটা ওক গাছের নিচে ভোজের ব্যবস্থা হলো। আয়োজন সামান্য। হরিণের মাংস আর এল। সবাই ফুর্তির সঙ্গে তাই খেলো। খাওয়ার ফাকে ফাঁকে নানা গল্পগুজব, ঠাট্টা তামাশা চলতে লাগলো। সামনে যে দেশের রাজা বসে আছেন, তা যেন তারা ভুলে গেছে। রাজাও তাঁর গাম্ভীর্য ভুলে ওদের ঠাট্টা রসিকতায় যোগ দিয়েছেন।
২১. গোধূলি লগ্ন
সন্ধ্যা তখনো হয়নি। গোধূলি লগ্ন।
আইভানহো, গাৰ্থ আর ওয়াম্বাকে নিয়ে কনিংসবার্গ দুর্গে পৌঁছালেন রিচার্ড। অস্তায়মান সূর্যের লাল আলোয় অপূর্ব দেখাচ্ছে দুর্গটাকে।
এমনিতেই প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্যে বিখ্যাত কনিংসবার্গ। ডন নদী জায়গাটিকে অর্ধবৃত্তাকারে ঘিরে বয়ে যাচ্ছে। এক দিকে বনভূমি, অন্য দিকে শস্য ক্ষেত। বনভূমির প্রান্ত থেকে ধীরে ধীরে উঁচু হয়ে পাহাড়ের চেহারা নিয়েছে জায়গাটা। তারই চূড়ায় কনিংসবার্গের দুর্গ প্রাসাদ। নরম্যানরা ইংল্যান্ড জয় করার আগে স্যাক্সন রাজারা এখানে বাস করতেন।
দুর্গের চূড়ায় একটা কালো পতাকা উড়ছে। শোকের প্রতীক। স্যাক্সন রাজপুত্র অ্যাথেলস্টেনের মৃত্যুতে এই শোক। কনিংসবার্গ প্রাসাদে আজ সবাই সমবেত হয়েছেন অ্যাথেলস্টেনের মৃত্যু পরবর্তী ভোজে যোগ দিতে। মৃতের নিকট ও দূর সম্পর্কের আত্মীয়রা ছাড়াও নিমন্ত্রিত হয়ে এসেছেন সেড্রিক ও অ্যাথেলস্টেনের বহু বন্ধুবান্ধব। তাদের কলগুঞ্জনে গম গম করছে প্রাসাদ। দলে দলে লোক উপরে যাচ্ছে, নিচে নেমে আসছে। খাওয়া দাওয়ার বিরাট আয়োজন। অঢেল মাংস আর মদ। ইচ্ছে মতো খাচ্ছে নিমন্ত্রিতরা।
রিচার্ড সঙ্গীদের নিয়ে পৌঁছুতেই সেড্রিকের এক পার্শ্বচর তাদের উপরে নিয়ে গেল। সিঁড়ি দিয়ে উঠবার সময় আইভানহো হুড দিয়ে ঢেকে নিলো মাথাটা। মুখেরও বেশির ভাগ ঢাকা পড়ে গেল তাতে। রিচার্ডের নির্দেশ পাওয়ার আগে বাবার কাছে পরিচয় দিতে চায় না ও।
উপরের বিরাট হলঘরটায় কয়েক জন বিশিষ্ট স্যাক্সন বন্ধুকে নিয়ে বসে ছিলেন সেড্রিক। ব্ল্যাক নাইট প্রবেশ করতেই তিনি উঠে দাঁড়িয়ে তাঁকে অভ্যর্থনা জানালেন।
জনাব সেড্রিক, আপনার প্রতিশ্রুতির কথা মনে করিয়ে দিতে এলাম। শেষবার যখন আমাদের দেখা হয়েছিলো, আমি আপনার কাছে একটা জিনিস চাইবো বলেছিলাম, নিশ্চয়ই ভুলে যাননি?
সে জিনিসততা আমি আপনাকে দিয়ে দিয়েছি, স্যার নাইট, বললেন সেড্রিক। কি জিনিস এবার বলুন।
বলছি, তার আগে আমার পরিচয় জানা দরকার আপনার। আমারও কর্তব্য পরিচয় দেয়া, বললেন ব্ল্যাক নাইট। এখন পর্যন্ত আপনি এবং আরো অনেকে আমাকে ব্ল্যাক নাইট বলে জেনে এসেছেন। আসলে আমি রিচার্ড, ইংল্যান্ডের রাজা।
বিস্ময়ে হতবাঁক হয়ে গেলেন সেড্রিক।
আপনি–আপনি রিচার্ড! কোনো মতে উচ্চারণ করলেন তিনি। সিংহ-হৃদয় রিচার্ড!
হ্যাঁ, সেড্রিক। আমি চাই আমার রাজ্যে সবাই–স্যাক্সন নরম্যানসবাই মিলেমিশে শান্তিতে বাস করুক। সেজন্যেই আপনার এখানে এসেছি। এবার, আমি যা চাইবো বলেছিলাম–আমি চাই, না, আমার অনুরোধ আইভানহোকে আপনি ক্ষমা করুন। এই যে আমার সঙ্গে এই যুবকই আপনার পুত্র।
সঙ্গে সঙ্গে মাথা থেকে হুডটা সরিয়ে ফেলে বাবার পায়ে পড়লো আইভানহো।
আমাকে ক্ষমা করো, বাবা, মিনতি করলো সে।
ওঠ, বাপ, পায়ের কাছ থেকে ছেলেকে তুলতে তুলতে বললেন সেড্রিক। অনেক আগেই তোকে আমি ক্ষমা করেছি।
কি একটা বলার চেষ্টা করলো আইভানহো। সেড্রিক বাধা দিয়ে বললেন, বুঝেছি তুই কি বলতে চাস। রোয়েনার কথা তো? সবে মাত্র মারা গেছে অ্যাথেলস্টেন, এখন অন্তত দুবছর অপেক্ষা করতে হবে তোদর। নইলে অ্যাথেলস্টেনের বিক্ষুব্ধ আত্মা কবর থেকে অভিশাপ দেবে।
বলতে না বলতেই অ্যাথেলস্টেন সেখানে হাজির। ভূত দেখার মতো চমকে উঠলো সবাই। যারা একটু ভীতু, আতঙ্কে শিউরে উঠলো তারা।
তুমি মানুষ না প্রেত জানি না; কম্পিত কণ্ঠে সেড্রিক বললেন। যদি মানুষ হও তাহলে কথা বলো।
আমি অ্যাথেলস্টেন। আপনাদের মতোই মানুষ। হ্যাঁ, আমি মরিনি। তিন দিন শুধু পানি খেয়ে থাকার পর ছুটতে ছুটতে এখানে এসেছি। আমাকে একটু নিশ্বাস ফেলার সময় দিন।
তুমি অ্যাথেলস্টেন! বিস্মিত কণ্ঠে বললেন রিচার্ড। কিন্তু তোমাকে তো দেখলাম বোয়া-গিলবার্টের তলোয়ারের ঘায়ে পড়ে যেতে! তা ছাড়া, ওয়াম্বা না কে যেন এসে বললো, তোমার দাঁত সব ভেঙে গেছে, মাথার বুলিও ফেটে গেছে।
ওয়াম্বা আপনাকে ভুল খবর দিয়েছে। আমার মাথা যে ফেটে যায়নি, দেখতেই পাচ্ছেন। দাঁতও ঠিক আছে। খাওয়ার সময়ই তা বুঝতে পারবেন। ব্রায়ান শক্ত আঘাতই করেছিলো আমাকে, কিন্তু মাথাটা সরিয়ে নিয়েছিলাম বলে প্রাণে মরিনি, অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলাম কেবল। এর পর দুপক্ষের বহু যোদ্ধা মরে আমাকে চাপা দেয়। জ্ঞান ফিরে পেয়ে দেখি কফিনের ভেতর শুয়ে আছি। ভাগ্য ভালো কফিনটার মুখ খোলা ছিলো। তাই কোনো রকমে বেরিয়ে অনেক কষ্টে এখানে আসতে পেরেছি।