সেড্রিক মানুষটা মাঝারি উচ্চতার। চওড়া দৃঢ় কাঁধ, দেখলেই বোঝা যায় অপরিমেয় শক্তি ধরেন এ কাঁধের মালিক। দীর্ঘ, পরিপাটি চুলগুলো ঝুলে পড়েছে ঘাড়ের নিচে। মুখটায় অদ্ভুত এক সারল্য। প্রথম দর্শনেই মনে হয়, ঘোরপ্যাচ নেই এ লোকের অভাবে। যা করার সোজাসুজি করেন। ফারের কিনারা দেওয়া সবুজ একটা কোট পরে আছেন তিনি। দুহাতে সোনার বাজু, গলায় সোনার চাকতি।
কয়েক জন ভৃত্য দাঁড়িয়ে আছে পাশে, প্রভুর আদেশের অপেক্ষায়। আরো কয়েক জন দাঁড়িয়ে একটু দূরে, দরজার কাছে। এক পাল কুকুর বসে আছে আগুনের সামনে। সেড্রিকের সবচেয়ে প্রিয়, বিশ্বস্ত উলফ-হাউন্ড বলডার বসে আছে তার পায়ের কাছে। যেন ভৃত্যদের মতো সে-ও অপেক্ষা করছে প্রভুর আদেশের।
সেড্রিকের খাবার ঘরটা বিরাট। যেমন লম্বায় তেমনি চওড়ায়। অনেক মানুষ এক সাথে বসে খেতে পারে। দুখানা খাবার টেবিল এ ঘরে। একটা বেশ বড়, ঘরের প্রায় অর্ধেকটা জুড়ে আছে। সাধারণ এক কাঠের তৈরি। উপরে কোনো ঢাকনা নেই। রদারউডের সাধারণ বাসিন্দারা এটায় খাওয়া দাওয়া করে। অন্য টেবিলটা ছোট, বড়টার চেয়ে সামান্য উঁচু। দামী কাঠের তৈরি। দেখতেও সুন্দর। অন্যটার চেয়ে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। রঙিন একটা ঢাকনি পাতা সেটার ওপর। এক প্রান্তে দুটো চেয়ার, অন্য চেয়ারগুলোর চেয়ে একটু উঁচু। সেড্রিক আর রোয়েনা ছাড়া আর কারো বসার অনুমতি নেই ও দুটোয়। বিশিষ্ট অতিথি অভ্যাগত এলে এই টেবিলেই তাদের খেতে দেয়া হয়।
বদমেজাজী সেল্লিকের মেজাজটা মোটেই ভালো নেই। সারা সন্ধ্যা একা একা কাটিয়েছেন।
দূরের এক গির্জায় গিয়েছিলো রোয়েনা। মাত্র কয়েক মিনিট আগে ফিরেছে ভিজতে ভিজতে। গার্থ এখনও ফেরেনি শুয়োরের পাল নিয়ে। কোথায় যেতে পারে ও? ভাবছেন সেড্রিক। নরম্যানরা কি শুয়োরের পালসুদ্ধ ধরে নিয়ে গেল ওকে? আর ওয়াম্বা? সে-ই বা কোথায়? ও থাকলেও না হয় দুচারটে মজার কথা শোনা যেতো। ওকেও কি ধরে নিয়ে গেছে নরম্যানরা? রাগের সাথে সাথে হঠাৎ এক অদ্ভুত দুঃখ মেশানো অনুভূতি হলো সেড্রিকের
আহ, আমার ছেলে, মনে মনে বললেন তিনি, তুই যদি এখন কাছে। থাকতি এই বুড়ো বয়সে আমাকে বন্ধুহীন একা একা দিন কাটাতে হতো না। দীর্ঘ একটা নিশ্বাস বেরিয়ে এলো তার বুকের গভীর থেকে।
বেশ খিদে পেয়েছে সেড্রিকের। খাবার সময়ও হয়েছে অনেকক্ষণ আগে। অথচ রোয়েনা না আসা পর্যন্ত খেতে বসতে পারছেন না। মেজাজ খারাপ হওয়ার এটাও একটা কারণ। একটু পরপরই বিরক্তির দৃষ্টিতে তাকাচ্ছেন কোনো ভূতের দিকে। যেন রোয়েনার দেরি করে আসাটা তারই দোষ। মাঝে মাঝে বিড় বিড় করছেন, গির্জায় যাওয়ার আর দিন পেলো
হঠাৎ রোয়েনার খাস পরিচারিকা এলগিটাকে দরজার সামনে দিয়ে যেতে দেখলেন তিনি। অমনি হেঁড়ে গলায় চিৎকার: এত দেরি করছে কেন রোয়েনা, হ্যাঁ?
কাপড় বদলাচ্ছেন, বিনীত কণ্ঠে বললো এলগিটা। পুরোদস্তুর ভিজেছেন বৃষ্টিতে।…আর বোধহয় বেশিক্ষণ লাগবে না।
চলে গেল এলগিটা। এই সময় বাইরে থেকে বৃষ্টির শব্দ ছাপিয়ে ভেসে এলো শিঙার আওয়াজ। ঘরে যতগুলো কুকুর ছিলো সব কটা এক সঙ্গে ঘেউ ঘেউ করে উঠলো। লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ালো বলডার। সে-ও সমানে চিৎকার করছে।
এক ভৃত্যের দিকে তাকিয়ে সেড্রিক আদেশ করলেন, যাও তো, কে এলো দেখে এসো।
কয়েক মিনিটের ভেতর ফিরে এলো ভৃত্য।
জরভক্স মঠের প্রায়োর অ্যায়মার আর নাইট টেম্পলার ব্রায়ান দ্য বোয়া-গিলবার্ট এসেছেন, সে বললো। রাতের মতো খাদ্য ও আশ্রয় চাইছেন। পরশুদিন অ্যাশবিতে যে টুর্নামেন্ট (অস্ত্র চালনা প্রতিযোগিতা) হবে তাতে যোগ দেবার জন্যে যাচেছন অরা। হঠাৎ করে ঝড়-বাদল শুরু হয়ে যাওয়ায় এখানে আশ্রয় চাইছেন।
ফাদার অ্যায়মার! টেম্পলার ব্রায়ান! চিন্তিত মুখে ভাবলেন জমিদার, দুজনেই নরম্যান!–হোক নরম্যান তবু তো অতিথি। অতিথির জন্যে রদারউডের দুয়ার সবসময় ভোলা। ওরা এখানে থাকতে চায় ভাল কথা। আরও ভালো হতো যদি আরেকটু এগিয়ে গিয়ে অন্য কোথাও উঠতো। যাকগে তা যখন ওঠেনি–একটা রাতেরই তো ব্যাপার, নিশ্চয়ই কাল ভোরেই ওরা চলে যাবে, তাহলে আর চিন্তা কি? ভৃত্যের দিকে ফিরে হাঁক ছাড়লেন, যাও নিয়ে এসো ওদের। অতিথিদের ঘরে নিয়ে যাবে আগে। হাত-পা ধোঁয়ার পানি দেবে, যদি ভিজে গিয়ে থাকে শুকনো কাপড় দেবে। তারপর নিয়ে আসবে এখানে। সহিসকে বলবে ওদের ঘোড়াগুলোর যেন যত্ন নেয়।
ভূত্য ঘুরে দাঁড়াতেই তিনি আবার বললেন, ওদের বোলো, আমি নিজেই যেতাম। কিন্তু আমার একটা প্রতিজ্ঞা আছে, যে কারণে স্যাক্সন ছাড়া অন্য কাউকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্যে এই চেয়ার ছেড়ে তিন পায়ের বেশি আমি নড়তে পারি না। ওরা যেন কিছু মনে না করেন।
চলে গেল ভৃত্য। আবার চিন্তার সাগরে ডুব দিলেন সেড্রিক।
প্রায়োর অ্যায়মার, মদ মাংসের পাগল! আর ব্রায়ান দ্য বোয়া গিলবার্ট, ভালো মন্দ দুকারণেই বিখ্যাত তার নাম। দুর্ধর্ষ সৈনিক, তবে ভয়ানক অহঙ্কারী, নিষ্ঠুর আর বদ স্বভাবের। অতিথি ভেবে বাড়িতে তো জায়গা দিচ্ছি, তারপর কি হবে কে জানে?
অসওয়াল্ড! চিৎকার করে তাঁর প্রধান ভূত্যকে ডাকলেন সেড্রিক। তলকুঠুরিতে যাও। সবচেয়ে ভালো মদের পিপেটার মুখ ভোলো। আরেক ভৃত্যকে বললেন, তুমি যাও, এলগিটাকে পাঠিয়ে দাও।