হুঁ , তোমার কথাই ঠিক, বলতে বলতে শিরোস্ত্রাণের মুখাবরণটা নামিয়ে দিলো নাইট। ঠিক সেই সময় পর পর তিনটে তীর এসে লাগলো তার বুকে, মাথায়, মুখে। সময় মতো মুখাবরণটা নামিয়ে দেয়ায় এযাত্রা বেঁচে গেছে নাইট।
তুমি এখানে দাঁড়াও, ওয়া; ওদের একটু শিক্ষা দিয়ে আসি, বলে নাইট ঘোড়া ছুটিয়ে দিলো ঝোপটার দিকে।
কিন্তু নাইট পৌঁছানোর আগেই ঝোপের ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো সাত জন সশস্ত্র লোক। এক সঙ্গে নাইটকে আক্রমণ করলো তারা। তিন জনের বর্শা ভেঙে গেল নাইটের বর্মে লেগে।
এসবের মানে কী? চিৎকার করে উঠলো নাইট।
জবাব না দিয়ে তলোয়ার বের করলো লোকগুলো। চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে আবার আক্রমণ করলো নাইটকে।
মরো, ব্যাটা নকল রাজা, গর্জন করে উঠলো একজন।
ব্ল্যাক নাইট খেয়াল করলো, লোকটার পরনে নীল বর্ম, নীল পোশাক, নীল ঢাল।
বিশ্বাসঘাতকের দল! পাল্টা গর্জন করে তলোয়ার বের করলো নাইট।
চারদিক থেকে আক্রান্ত হয়ে একটু দিশেহারা অবস্থা ব্ল্যাক নাইটের। সামনের জনের আঘাত প্রতিহত করেই বিদ্যুৎগতিতে তাকে পেছনে নয়তো ডানে বা বায়ে ঘুরতে হচ্ছে। হঠাৎ নীল বর্ম পরা লোকটা প্রচণ্ড এক আঘাত হানলো ব্ল্যাক নাইটের ঘোড়া লক্ষ্য করে। সঙ্গে সঙ্গে আরোহীকে নিয়ে মাটিতে পড়ে গেল ঘোড়াটা। লাফ দিয়ে এগিয়ে এলো নীল পোশাক পরা নাইট।
আর দেরি করা সমীচীন মনে করলো না ওয়াম্বা। শিঙাটা মুখে লাগিয়ে জোরে ফুঁ দিলো তিনবার। অমনি গুণ্ডাগুলো চমকে উঠে পিছিয়ে গেল কয়েক পা। প্রত্যেকেরই অস্ত্র যেন জমে গেছে যার যার হাতের সাথে। ওয়াম্বা একজনের কাছ থেকে একটা তলোয়ার কেড়ে নিয়ে ছুটে গেল ব্ল্যাক নাইটের সাহায্যে।
লজ্জা করে না, ভীরুর দল! যত না তলোয়ার চালাচ্ছে তার চেয়ে বেশি চিৎকার করছে ওয়াম্বা। সামান্য একটা শিঙার শব্দ শুনে পালাচ্ছো! তাও কিনা বাজিয়েছে একটা ভড়!
এবার আবার ব্ল্যাক নাইটকে আক্রমণ করলো খুনীরা। বিরাট একটা ওক গাছের গুঁড়িতে পিঠ ঠেকিয়ে তলোয়ার হাতে আত্মরক্ষা করতে লাগলো নাইট। তলোয়ার দিয়ে বেশ কিছুক্ষণ চষ্টা করার পরও যখন ব্যর্থ হলো তখন আবার বর্শা তুলে নিলো নীল-নাইট। বাগিয়ে ধরে ছুটে আসতে লাগলো। ওয়াও ছুটলো তলোয়ার হাতে। নীলনাইটের ঘোড়ার পায়ে গায়ের সমস্ত জোর দিয়ে একটা আঘাত হানলো সে। ঘোড়া এবং আরোহী দুজনই পড়ে গেল মাটিতে। এযাত্রা বাঁচলো বটে ব্ল্যাক নাইট কিন্তু আর কতক্ষণ বাঁচবে তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। সে মাটিতে দাঁড়িয়ে, একা; প্রতিপক্ষ ছসাত জন। ক্রমেই ক্লান্ত হয়ে পড়েছে সে।
এই সময় হঠাৎ লেজের দিকে হাঁসের পালক লাগানো একটা তীর এসে লাগলো এক আক্রমণকারীর বুকে। লুটিয়ে পড়লো লোকটা। মুহূর্তে ছুটে এলো আরো তীর, এবার এক ঝাঁক। আরো কয়েক জন দুবৃত্ত পড়ে গেল আহত বা নিহত হয়ে। নীল-নাইটও আছে তাদের ভেতর।
কয়েক সেকেন্ড পরেই গাছপালার আড়াল থেকে বেরিয়ে এলো একদল লোক। সবার পরনে সবুজ পোশাক, হাতে তীর ধনুক। দলের একেবারে সামনে লক্সলি আর কপম্যানহাস্টের সন্ন্যাসী।
লক্সলিকে ধন্যবাদ জানালো ব্ল্যাক নাইট। লক্সলির মনে হলো আজ যেন একটু গম্ভীর ব্ল্যাক নাইটের কণ্ঠস্বর।
চলো দেখি, কে এই নীল-নাইট? বলে এগিয়ে গেল ব্ল্যাক নাইট। ওয়াম্বা, শিয়োস্ত্রাণটা খোলো তো!
নির্দেশ পালন করলো ওয়াম্বা।
ওয়াল্ডেমার! সবিস্ময়ে উচ্চারণ করলো ব্ল্যাক নাইট। কে পাঠিয়েছে তোমাকে?
আপনার ভাই, রাজপুত্র জন।
আমার ভাই জন! দয়া ভিক্ষা চাইবে না, ওয়াল্ডেমার?
সিংহ কখনো দয়া করে না।
আহত পশুকে আক্রমণও করে না সিংহ। না ওয়েল্ডেমার, তোমাকে আমি হত্যা করবো না। তবে, তিন দিনের ভেতর ইংল্যান্ড ছাড়বে তুমি। না হলে তোমার ভাগ্যে কি আছে আমি বলতে পারি না। লক্সলি, ওকে একটা ঘোড়া দিয়ে দাও।
তার চেয়ে ওর বুকে একটা তীর ঢুকিয়ে দিতে পারলেই ভালো লাগতো আমার। কিন্তু আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে আপনার আদেশ পালন করতেই হবে।
হ্যাঁ, আমার আদেশ তোমাকে পালন করতেই হবে। আমি ইংল্যান্ডের রাজা রিচার্ড।
চমকে উঠলো লক্সলি। সঙ্গে সঙ্গে রাজদ্রোহীরা হাঁটু গেড়ে বসে রাজার প্রতি তাদের আনুগত্য প্রকাশ করলো।
বন্ধুগণ, তোমরা উঠে দাঁড়াও, রিচার্ড বললেন। আজ তোমরা আমার জীবন বাঁচিয়েছো। টরকুইলস্টোনে তোমাদের বীরত্ব আমি দেখেছি। তোমাদের আমি ক্ষমা করলাম। আজ থেকে তোমরা আর রাজদ্রোহী নও, রাজার মিত্র। ললির দিকে ফিরলেন রিচার্ড। ললি–শুরু করলেন তিনি।
আমাকে আর ও নামে ডাকবেন না, মহানুভব, বাধা দিয়ে বললো লক্সলি। আমি শেরউড বনের রবিনহুড।
ঠিক এই সময় আইভানহো আর গাৰ্থ টগবগিয়ে ঘোড়া ছুটিয়ে হাজির হলে সেখানে। রিচার্ডের ধূলি মলিন চেহারা, সামনে ছসাতটা আহত নিহত দেহ, চারপাশে বনদস্যুদের ভীড়–এসব দেখে আইভানহো বিস্মিত হয়ে ভাবতে লাগলো, রিচার্ডকে রাজা বলে না ব্ল্যাক নাইট বলে সম্বোধন করবে।
তার দ্বিধা বুঝতে পারলেন রিচার্ড। বললেন, আইভানহো, আমার আসল নামেই এখন তুমি আমাকে ডাকতে পারো। এই মাত্র এদের আমি বললাম, আমি কে। কিন্তু তোমার ওপর খুবই অসন্তুষ্ট হয়েছি আমি। কালকের আগে সেইন্ট বটল প্রায়োরি ছাড়তে নিষেধ করেছিলাম তোমাকে।