চুপ করে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো রেবেকা। তারপর বললো, চ্যাম্পিয়ন জোগাড় করার জন্যে আমি আমার আত্মীয়-স্বজনদের সাথে যোগাযোগ করার সুযোগ প্রার্থনা করছি।
সংগত প্রার্থনা। দেখ এখানে যারা আছে তাদের কেউ তোমার আত্মীয়-স্বজনদের কাছে যেতে রাজি আছে কি না।
উপস্থিত জনতার উদ্দেশ্যে রেবেকা বললো, সত্যের খাতিরে বা অর্থের বিনিময়ে আমার একটা চিঠি আমার বাবার কাছে পৌঁছে দিতে রাজি আছেন কেউ চুপ করে আছে জনতা। খোদ গ্র্যান্ডমাস্টারের সামনে ডাইনীর অভিযোগে অভিযুক্ত একজন ইহুদী নারীকে সাহায্য করার সাহস কেউ পাচ্ছে না।
এই সামান্য উপকারটুকু করার সৎসাহস কারো নেই! বললো রেবেকা। তাহলে কি আমি আত্মরক্ষার কোনো সুযোগই পাবো না?
সাক্ষী দেয়ার পর থেকেই অনুতাপে দগ্ধ হচ্ছিলো হিগের অন্তর। এবার সে উঠে দাঁড়ালো। বললো, আমি পঙ্গু, ভালো করে হাঁটতে পারি না। তবু আমি নেবো এ ভার।
ঈশ্বরের অনুগ্রহ হলে বোবা কথা বলতে পারে, পঙ্গু পাহাড় ডিঙাতে পারে, স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বললো রেবেকা। চিন্তা কোরো না, হিগ, ঈশ্বরই তোমাকে হাঁটার শক্তি দেবেন। এরপর রেবেকা গ্র্যান্ডমাস্টারের দিকে তাকিয়ে বললো, আমি একটা চিঠি লিখবো আমার বাবার কাছে। আমাকে কাগজ কলম দেয়া হোক।
আসামীকে কাগজ কলম দেয়ার নির্দেশ দিলেন গ্র্যান্ডমাস্টার।
সংক্ষেপে তার অবস্থার কথা লিখে চিঠিটা হিগের হাতে দিলো রেবেকা। বললো, আমার বাবাকে দেবে চিঠিটা। মনে রেখো, তোমার ওপরেই আমার জীবন মরণ নির্ভর করছে।
আমার প্রতিবেশী বুথানের ঘোড় নিয়ে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমি ইয়র্কে পৌঁছানোর চেষ্টা করবো, বলে বিদায় নিলো হিগ।
ভাগ্য ভালো হিগের, রেবেকারও।
পথে নামার কিছুক্ষণের ভেতর হিগ দেখলো, দুজন ইহুদী টেম্পলস্টোর দিকেই আসছে। আরেকটু কাছাকাছি হতেই সে চিনতে পারলো, দুই ইহুদীর একজন আইজাক। তাঁকে থামিয়ে রেবেকার চিঠিটা তাঁর হাতে দিলো হিগ।
গভীর হতাশা নিয়ে আইজাক পড়লেন:
বাবা,
আমার বিরুদ্ধে ডাইনীর অভিযোগ আনা হয়েছে। যদি কোনো নাইট আমার পক্ষ হয়ে লড়ে জয়লাভ করতে পারেন একমাত্র তাহলেই প্রমাণ হবে আমি নির্দোষ। তা না হলে আমাকে আগুনে পুড়িয়ে মারা হবে। তিন দিন সময় দেয়া হয়েছে আমাকে। এর মধ্যে যদি কোনো নাইট আমার পক্ষ হয়ে লড়তে রাজি না হন, তাহলে আমার বাঁচার কোনো আশা নেই। আমার ধারণা, স্যাক্সন সেড্রিকের পুত্র আইভানহো নিজেই আমার পক্ষে লড়তে রাজি হলেন, অবশ্য এর ভেতর যদি তিনি সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠে থাকেন। যদি তিনি এখনো সুস্থ না হয়ে থাকেন তবু আমার বিশ্বাস, কাউকে না কাউকে তিনি পাঠাবেন। আইভানহোকে এই খবর দিয়ে বলবেন, রেবেকা নির্দোষ।
————
* চ্যাম্পিয়ন: অন্য একজনের হয়ে লড়াই করে যে নাইট।
** সে যুগের রীতি অনুযায়ী এ ধরনের যুদ্ধে যে জয়ী হতো, ধরে নেয়া হতো তার দাবিই সঠিক।
১৯. বন্ধ দরজায় মৃদু করাঘাত
সেদিনই সন্ধ্যা।
বন্ধ দরজায় মৃদু করাঘাত শুনতে পেলো রেবেকা।
যদি বন্ধু হন, নির্ভয়ে ভেতরে আসুন, বললো ও। আর যদি শক্ত হন, আপনাকে বাধা দেয়ার ক্ষমতা তো আমার নেই।
আমি তোমার শত্রু কি বন্ধু এখনই ঠিক হবে, বলতে বলতে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকলো টেম্পলার ব্রায়ান।
তাকে দেখেই রেবেকা জড়সড় হয়ে ঘরের এক কোণে গিয়ে দাঁড়ালো।
আমাকে দেখে ভয় পাওয়ার কিছু নেই রেবেকা, বললো ব্রায়ান। অন্তত এখানে নেই। তুমি ডাকলেই রক্ষীরা ছুটে আসবে।
না, আপনাকে আমার আর ভয় নেই, বললো রেবেকা। ঈশ্বর আমাকে নির্ভয় হওয়ার শক্তি দিয়েছেন। কিন্তু, আবার কেন আমাকে বিরক্ত করতে এসেছেন? আপনার যা বলার তাড়াতাড়ি বলে বিদায় নিন।
আমি তোমাকে বিরক্ত করতে বা তোমার সাথে তর্ক করতে আসিনি, রেবেকা। শুধু জানাতে এসেছি চ্যাম্পিয়ন দাবি করার কাগজটা কে তোমাকে দিয়েছিলো?–এই আমি।
তাতে কয়েকটা দিন সময় পাওয়া গেছে শুধু। তার বেশি আর কি হয়েছে?
না, রেবেকা, সত্যিই আমি তোমাকে বাঁচাতে চেয়েছিলাম। আমি ভেবেছিলাম, আমিই তোমার চ্যাম্পিয়ন হবো। আমার সঙ্গে এখানকার কেউই কয়েক মিনিটের বেশি টিকতে পারতো না। নিশ্চয়ই আমি জয়ী হতাম, আর তাহলে তুমি নির্দোষ তা প্রমাণ হয়ে যেতো। কিন্তু গ্র্যান্ড মাস্টার সব মাটি করে দিলেন। আমাকে তিনি নির্বাচিত করলেন মঠের পক্ষ থেকে লড়বার জন্যে।
আর আপনি তা নির্দ্বিধায় স্বীকার করে নিলেন! এরকমই তো বাঁচাতে চেয়েছিলেন। এখন যদি আমার পক্ষে কোনো নাইট লড়তে রাজি হন, আপনি প্রাণপণে চেষ্টা করবেন তাকে পরাজিত করার। তবু ভান করছেন, আপনি আমার বন্ধু, আমাকে বাঁচাতে এসেছেন!
হ্যাঁ, এখনও আমি তোমার বন্ধু হতে পারি, তোমাকে বাঁচাতে পারি। কিন্তু সেজন্যে ভয়ানক মূল্য দিতে হবে আমাকে। সে মূল্য আমি দেবো কি তা নির্ভর করছে তোমার সিদ্ধান্তের ওপর।
আমার সিদ্ধান্তের ওপর?
হ্যাঁ, সম্পূর্ণ তোমার সিদ্ধান্তের ওপর। তুমি যদি বলো, আমি লড়বো না মঠের হয়ে। তাহলে অবশ্য নাইট বলে আর নিজের পরিচয় দিতে পারবো না, জীবন কাটাতে হবে অপমানের বোঝা মাথায় নিয়ে। কিন্তু তাতেও আমি রাজি, শুধু একবার তুমি বলো, আমাকে ভালোবাসো।
পাগলামি ছাড়ন, টেম্পলার। সত্যি সত্যিই যদি আমাকে বাঁচানোর ইচ্ছা থাকে, রিচার্ডের কাছে গিয়ে আমার কথা বলুন। শুনেছি তিনি নাকি দেশে ফিরেছেন। তিনিই এই অন্যায়ের প্রতিকার করবেন।