বিপক্ষে সাক্ষী দেয়ার জন্যে বেশ কয়েকজনকেই পাওয়া গেল। বেশির ভাগই টেম্পলার ব্রায়ানের সঙ্গী। কি করে নাইট টেম্পলার রায়ান দ্য, বোয়াগিলবার্ট টরকুইলস্টোন দুর্গ রক্ষার দায়িত্ব উপেক্ষা করে, নিষ্ট্রের প্রাণ বিপন্ন করে আগুনের হাত থেকে রেবেকাকে বাঁচিয়েছে তার বিশদ বিবরণ দিলো তারা।
আসামীর অতীত জীবন সম্পর্কে সাক্ষ্য দিতে পারে এমন কেউ এখানে আছে? জিজ্ঞেস করলেন গ্র্যান্ড মাস্টার।
দর্শকদের ভেতর থেকে কেউ কোনো সাড়া শব্দ করলো না।
মানে, আমি বলতে চাইছি, আবার বললেন গ্র্যান্ডমাস্টার, আসামী যে অনেকদিন ধরেই জাদুবিদ্যার চর্চা করে আসছে তা কেউ জানে?
এবার হলঘরের এক কোণে একটু গোলমাল মতো শুরু হলো। গ্র্যান্ড মাস্টার তার কারণ জানতে চাইলেন। জানা গেল, সেখানে এক কৃষক উপস্থিত আছে, যে এক সময় মারাত্মক অসুস্থ হয়ে শয্যাশায়ী ছিলো। কোনো চিকিৎসকের ওষুধে তার অসুখ ভালো হয়নি। পরে আজকের আসামীই তুকতাক করে তাকে অনেকখানি সুস্থ করে তুলেছে। এখন সে লাঠি ভর দিয়ে হাঁটতেও পারে।
গ্র্যান্ডমাস্টারের নির্দেশে অনিচ্ছা সত্ত্বেও উঠে দাঁড়ালো লোকটা।
তোমার নাম কি? জিজ্ঞেস করলেন গ্র্যান্ডমাস্টার।
হিগ।
কি হয়েছিলো বলো তো।
একটু ইতস্তত করে হিগ শুরু করলো তখন আমি আসামীর বাবা আইজাকের অধীনে কাজ করতাম। হঠাৎ একদিন অসুস্থ হয়ে পড়ি। তখন আসামীর নির্দেশ মতো ওষুধপত্র খেয়ে আমি অনেকখানি ভালো হয়ে উঠি।
ইহুদী ডাইনীর ওষুধে ভালো না হয়ে অসুখে মরাই তোমার জন্যে ভালো ছিলো, গ্র্যান্ড মাস্টার মন্তব্য করলেন।
যার কাছ থেকে এক সময় উপকার পেয়েছে গ্র্যান্ডমাস্টারের ভয়ে তার বিরুদ্ধে সাক্ষী দিতে হলো বলে মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেল হিগের। সে আর এখানে থাকবে না বলেই ঠিক করলো। কিন্তু বিচারের ফলাফল শেষ পর্যন্ত কি হয় তার জন্যে সে রয়ে গেল।
গ্র্যান্ডমাস্টার এবার রেবেকাকে জিজ্ঞেস করলেন, স্বপক্ষে বলার মতো কিছু আছে তোমার?
আপনার কাছে দয়া ভিক্ষা করে লাভ নেই, বললো রেবেকা। তা আমি করতেও চাই না। কিন্তু, টেম্পলার ব্রায়ান এখানে উপস্থিত আছেন, তাকেই আমি জিজ্ঞেস করছি, বলুন স্যার টেম্পলার, আমার বিরুদ্ধে যে ভয়ঙ্কর অভিযোগ আনা হয়েছে তা সম্পূর্ণ মিথ্যে ও ভিত্তিহীন কি না?
অখণ্ড নিস্তব্ধতা বিচার কক্ষে। টেম্পলার ব্রায়ানের জবাব শোনার জন্যে রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করছে সবাই।
মুখ খুলুন, টেম্পলার, আবার বললো রেবেকা। আপনি যদি মানুষ হন, যদি সত্যিকারের খ্রীষ্টান হন, আমার কথার জবাব দিন! আপনি যদি সত্যিকারের নাইট হয়ে থাকেন তাহলে তার মর্যাদা রাখুন।
জবাব দাও, ব্রায়ান দ্য বোয়া গিলবার্ট! নির্দেশ দিলেন গ্র্যান্ড মাস্টার।
ব্রায়ানের মনে তখন দ্বন্দ্ব চলছে। তার কথার ওপর নির্ভর করছে রেবেকার জীবন। আবার সত্য বললে ধুলায় গড়াগড়ি যাবে তার নিজের মান মর্যাদা সুনাম। এই দোটানায় পড়ে অনেকক্ষণ সে কোনো কথা বলতে পারলো না। অবশেষে তার মুখ দিয়ে একটা মাত্র কথা বেরোলো-ভাঁ-ভাঁজ করা কাগজ!
এই ডাইনীর জাদু শক্তি এমনই যে আমাদের টেম্পলার কথা বলার শক্তি পর্যন্ত হারিয়ে ফেলেছে, গ্র্যান্ডমাস্টার বললেন। তবে অনেক কষ্টে যে কাগজের কথা ও বলেছে তা-ই সাক্ষ্যের কাজ করবে। দেখাও, ডাইনী, কাগজটা!
রেবেকাকে যখন বিচার সভায় আনা হয় তখন ভীড়ের ভেতর কে যেন তার হাতে একটা কাগজ গুঁজে দিয়ে যায়। রেবেকা এতক্ষণ তা খুলে দেখারও সুযোগ পায়নি। গ্র্যান্ডমাস্টারের কথায় সে সেটা খুলে দেখলো।
একজন চ্যাম্পিয়ন* দাবি কর, লেখা রয়েছে কাগজটায়।
কথা কটির মধ্যে একটু যেন আশার আলো দেখতে পেলো রেবেকা।
আমার বিরুদ্ধে যে অভিযোগ আনা হয়েছে তা সম্পূর্ণ মিথ্যে, ভিত্তিহীন, বললো সে। আমি নিরপরাধ। আপনাদের আইনে আছে, দুই যোদ্ধার মধ্যে দ্বন্দ্বযুদ্ধে** এ ধরনের অভিযোগের মীমাংসা হতে পারে। আমি প্রার্থনা করছি, এক্ষেত্রেও তাই করা হোক। মাননীয় বিচারকদের অনুমতি পেলে একজন চ্যাম্পিয়ন লড়বে আমার পক্ষ হয়ে।
তোমার মতো ডাইনীর পক্ষে লড়ার জন্যে কে এগিয়ে আসবে?
আমি যদি নিরপরাধ হই, ঈশ্বরই আমার পক্ষে লড়ার জন্যে কাউকে না কাউকে পাঠিয়ে দেবেন।
সহকারী বিচারকদের সাথে কয়েক মুহূর্ত পরামর্শ করলেন গ্র্যান্ড মাস্টার। অবশেষে বললেন, ঠিক আছে, তোমার প্রার্থনা মঞ্জুর করা হলো। তিন দিনের সময় দেয়া হচ্ছে। এর মধ্যে তোমাকে জোগাড় করতে হবে তোমার চ্যাম্পিয়ন। আমাদের মঠের পক্ষে লড়বে টেম্পলার ব্রায়ান দ্য বোয়া-গিলবার্ট।
তিন দিন যে খুব কম সময়।
হলেও কিছু করার নেই। এর চেয়ে বেশি সময় তোমাকে দেয়া যাবে না।
বেশ, রেবেকা বললো, ঈশ্বরের ইচ্ছা যদি তাই হয় আমি আর কি বলবো? আমি তারই ওপর সম্পূর্ণ নির্ভর করছি।
ম্যালভয়সিঁ, গ্র্যান্ডমাস্টার বললেন, এবার তাহলে লড়াইয়ের জায়গা ঠিক করে ফেল।
সেইন্ট জর্জ গির্জার সামনে যে ফাঁকা জায়গা আছে সেখানেই হতে পারবে।
ভালো কথা। রেবেকা, তিন দিনের ভেতর তুমি ওখানে তোমার চ্যাম্পিয়নকে হাজির করবে। যদি না পারো, বা তোমার চ্যাম্পিয়ন যদি পরাজিত হয় তাহলে ডাইনীদের যেভাবে পুড়িয়ে মারা হয় তোমাকেও সেভাবে পুড়িয়ে মারা হবে।