গলাটা সন্ন্যাসী বাবাজির। ইহুদী আইজাকের কোমরে দড়ি বেঁধে টানতে টানতে আসছেন তিনি। অন্য হাতে বিরাট একটা তলোয়ার, বন বন করে ঘোরাচ্ছেন মাথার ওপর। দেখে অদম্য হাসিতে ফেটে পড়লো সবাই।
এতক্ষণ কোথায় ছিলেন, ফাদার? জানতে চাইলো লক্সলি। আর এই ইহুদীকেই বা পেলেন কোথায়?
আর বোলো না, জবাব দিলেন কপম্যানহাস্ট্রের সরাসী, একটু ভালো পানীয় পাওয়ার আশায় টরকুইলস্টোন প্রাসাদের তল কুঠুরীতে ঢুকেছিলাম কাল বিকেলে। বেশ কিছুক্ষণ খোঁজাখুঁজির পর সবে ছোট্ট একটা মদের পিপের সন্ধান পেয়েছি, এমন সময় পাশের একটা ঘরের দিকে চোখ পড়লো। দরজায় তালা, কিন্তু চাবি দেয়া নয়। দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে দেখি এক কোনায় জড়সড় হয়ে বসে আছে এই বুড়ো। আমাকে দেখেই পা জড়িয়ে ধরলো। দয়া হলো আমার। ব্যাটাকে নিয়ে বেরিয়ে আসবো এমন সময় ওপর থেকে কড়ি বরগা খসে পড়ে বন্ধ হয়ে গেল বেরোনোর পথ। বাঁচার কোনো আশাই রইলো না। কিন্তু ইহুদীর সাথে মরবো–ভাবতেও পারি না শেষমেশ সিদ্ধান্ত নিলাম, তলোয়ারের এক ঘায়ে ব্যাটার কল্লাটা নামিয়ে দিই। জ্যান্ত ইহুদী আর মরা ইহুদীতেঅনেক তফাৎ, তাই না? কিন্তু বেচারার বয়স দেখে মায়া হলো আমার। তলোয়ার আর উঠলো না। শেষকালে ব্যাটাকে খ্রীষ্টধর্মের মহিমা শোনাতে শুরু করলাম। ভাবলাম তাতে হয়তো এই মহান ধর্মে ওর মতি হবে। মনে হয় কিছু ফল হয়েছে।
তাই নাকি, আইজাক? জিজ্ঞেস করলো লক্সলি।
মোটেই না, চিৎকার করে উঠলেন বৃদ্ধ ইহুদী। সারারাত আমার কানের কাছে উনি কি বকর বকর করেছেন, তার এক বর্ণ আমি বুঝিনি।
অবিশ্বাসী! তুমি মিথ্যে বলছো! এই নাও তার শাস্তি, বলতে বলতে ফাদার ঘুষি মারার জন্যে তৈরি হলেন আইজাককে।
ব্ল্যাক নাইট বাধা দিলো তাকে। বললো, ফাদার, এবারের মতো মাফ করে দিন অবিশ্বাসীকে।
তাহলে আপনিই নিন, বলে ঘুসি বাগিয়ে এগিয়ে এলেন ফাদার।
ধার হিশেবে হলে আপত্তি নেই। পরে সুদ আসলে শোধ দেবো। কি রাজি?
সন্ন্যাসীর ঘূসির ওজন মারাত্মক। কথাটা অনেকেই জানতো। তাই সবাই যখন দেখলো তার প্রমাণ আকারের একটা ঘুসি খেয়ে ব্ল্যাক নাইট একটু টললো না পর্যন্ত তখন তারা অবাক না হয়ে পারলো না।
এবার আমার ধার শোধ করার পালা। সোজা হয়ে দাঁড়ান, ফাদার, বলেই ব্ল্যাক নাইট তাকে এমন এক ঘুসি মারলো, চিৎ হয়ে মাটিতে পড়ে গেলেন ফাদার।
যাক, শোধ বোধ হয়ে গেল, উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললেন তিনি। এবার ইহুদীটার একটা ব্যবস্থা করে ফেলা উচিত। ও যখন কিছুতেই নিজের ধর্ম ছাড়বে না, তাহলে বলুক মুক্তিপণ হিশেবে কি দেবে।
দুশ্চিন্তার কিছু নেই, আইজাক, লক্সলি বললো, সময় নিয়ে ঠাণ্ডা মাথায় ভাবুন, কি দেবেন বা কত দেবেন, এই ফাঁকে আমরা আরেক বন্দীর সাথে আলাপ সেরে ফেলি। নিয়ে এসো ওকে!
লক্সলির কয়েক স্যাঙাৎ টানতে টানতে নিয়ে এলো জরভক্স মঠের প্রায়োর অ্যায়মারকে।
ডাকাতদের ওপর ভয়ানক রেগে গেছেন অ্যায়মার, আবার ভয়ও পেয়েছেন।
এ কি ধরনের আচরণ, চিৎকার করে উঠলেন তিনি। রাজার সড়ক থেকে একজন প্রায়োরকে ধরে আনো তোমরা, এত বড় সাহস! আমার জরুরি কাগজপত্র সব নিয়ে নিয়েছে। আমার পোশাক আশাক, সোনা দানা যা ছিলো সব…, দম নেয়ার জন্যে থামলেন তিনি।
হ্যাঁ, বলে যান, প্রায়োর, মৃদু হেসে বললো লক্সলি।
প্রায়োর দেখলেন তার রাগ দেখে মজা পাচ্ছে ডাকাতগুলো। কথা বলার ভঙ্গি বদলালেন তিনি। দেখ আমি শান্তিপ্রিয় মানুষ। তোমাদের ক্ষমা করে দিয়ে সব ভুলে যেতে রাজি আছি। কিন্তু তার আগে আমার কাছ থেকে যা যা তোমরা নিয়েছে সব ফেরত দেবে, আর ক্ষতিপূরণ হিশেবে দেবে একশো রৌপ্য মুদ্রা।
আমার লোকরা আপনার সাথে দুর্ব্যবহার করেছে বলে আন্তরিকভাবে দুঃখিত আমি, ফাদার, বললল ললি।
দুর্ব্যবহার! বিস্ময়ের সাথে উচ্চারণ করলেন প্রায়োর। শুধু দুর্ব্যবহার হলে তো কথা ছিলো না। ঐ লোকটা কি যেন নাম?–অ্যালান-আ-ডেল, বলে কি না, চারশো রৌপ্য মুদ্রা না দিলে আমাকে ফাঁসিতে ঝোলাবে! আমার সোনা দানা সব নেয়ার পরও এ কথা বলে!
আপনি ঠিক বলছেন, প্রায়োর? সত্যিই অ্যালান-আ-ডেল একথা বলেছে?
নিশ্চয়ই বলেছে!
তা হলে তো ও যা চেয়েছে, আপনাকে দিতেই হবে। অ্যালান-আডেল যা বলে তা করে ছাড়ে।
কী! চিৎকার করে উঠলেন হতভম্ব প্রায়োর। নিশ্চয় তোমরা রহস্য করছো। দেখ, রহস্য আমিও পছন্দ করি। কিন্তু এ ব্যাপারটা মোটেই তেমন না।
ঠিক, ফাদার, লক্সলি বললো, এ ব্যাপারটা মোটেই রহস্য নয়। আমরা যা চেয়েছি যদি না দেন এ বন থেকে প্রাণ নিয়ে বেরুতে পারবেন না।
এবার আর রাগ নয়, সত্যি সত্যিই ভয় ভর করলো প্রায়োর অ্যায়মারের মনে।
কত চাও তোমরা? জিজ্ঞেস করলেন তিনি।
সঙ্গে সঙ্গে কোনো জবাব দিলো না লক্সলি। দেরি দেখে ওর এক অনুচম বলে উঠলো, আমার একটা প্রস্তাব আছে, বলবো?
বলো।
আমার প্রস্তাব হলো, ইহুদী আইজাক ঠিক করুক প্রায়োর অ্যায়মারের মুক্তিপণ, আর আইজাকেরটা ঠিক করুক প্রায়োর।
হ্যাঁ, বুদ্ধিটা মন্দ না, একমত হলো লক্সলি। আইজাকের দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করলো, নিশ্চয়ই আপনি প্রায়োর অ্যায়মারকে চেনেন, তাঁর মঠ সম্পর্কেও জানেন ভালো করে?
হ্যাঁ, জবাব দিলেন বৃদ্ধ ইহুদী। ঐ মঠের সঙ্গে, ফাদার অ্যায়মারের সঙ্গেও আমি লেনদেন করেছি। মঠ এবং ফাদার দুজনেই ধনী।