তোমার চিৎকার শুনতে না পেলে কোনোদিনই তোমাকে খুঁজে বের করতে পারতাম না, বললো সে।
তুমি যদি সত্যিকারের নাইট হও, অস্থির কণ্ঠে বললো আইভানহো, আমার কথা ভেবে সময় নষ্ট কোরো না। ঐ টেম্পলারের পেছন পেছন যাও। রেবেকাকে উদ্ধার করো। রোয়েনা আর ওর বাপকে বাঁচাও!
হ্যাঁ, যাবো, কিন্তু আগে তুমি এসো, বলতে বলতে আইভানহোকে কাঁধে তুলে নিলো ব্ল্যাক নাইট।-নিরাপদে বেরিয়ে এলো দুর্গ থেকে। আইভানহোকে মোটামুটি নিরিবিলি একটা জায়গায় নামিয়ে রেখে আবার সে ছুটলো দুর্গের ভেতর অন্য বন্দীদের উদ্ধার করতে।
ইতোমধ্যে পশ্চিম পাশের মিনারে আগুন ছড়িয়ে পড়েছে। দুর্গের অন্যান্য অংশেও আগুন ধরেছে তবে অত মারাত্মকভাবে নয়। ঐ সব এলাকায় এখনো লড়াই চলছে। চিৎকার, হুঙ্কার আর আর্তনাদে ভারি হয়ে আছে বাতাস। মাটি পিচ্ছিল হয়ে গেছে রক্তে।
সেড্রিক আর গাৰ্থ ছুটতে ছুটতে দুর্গের প্রাসাদ অংশে ঢুকলেন। আগুনের অসহ্য উত্তাপ সয়েও একটা একটা করে বন্ধ ঘরের দরজা খুলে দেখতে লাগলেন তারা। অবশেষে পেলেন রোয়েনার খোঁজ। যে মুহূর্তে রোয়েনা বাঁচার আশা সম্পূর্ণ ছাড়তে বসেছে ঠিক সেই মুহূর্তে দরজা খুলে ঘরে ঢুকলেন সেড্রিক। পেছনে গাৰ্থ। ছুটে এসে সেড্রিককে জড়িয়ে ধরলো রোয়েনা। সেড্রিকও বুকে টেনে নিলেন মেয়েকে। এক মুহূর্ত,পরেই ওকে ছেড়ে দিয়ে গার্থের দিকে ফিরলেন তিনি। বললেন, জলদি, গার্থ, এক্ষুনি রোয়েনাকে নিয়ে বেরিয়ে যাও প্রাসাদ ছেড়ে। আমি আসছি।
অ্যাথেলস্টেন আর ওয়াম্বার খোঁজে ছুটলেন তিনি।
কিন্তু তার আগেই বুদ্ধি খাটিয়ে নিজের আর অ্যাথেলস্টেনের মুক্তির ব্যবস্থা করেছে ওয়াম্বা।
প্রাসাদ থেকে বেরিয়ে সবেমাত্র উঠানে এসে দাঁড়িয়েছে ওরা, এই সময় অ্যাথেলস্টেন দেখলো, একপাশে দাঁড়িয়ে আছে বোয়া-গিলবার্টের ঘোড়া। পাশে দাঁড়িয়ে কয়েকজন সবুজ পোশাক পরা সৈনিকের সাথে লড়ছে টেম্পলার। ঘোড়াটার পিঠে অচেতন হয়ে ঝুলছে এক তরুণী। নিশ্চয়ই রোয়েনা, ভেবে ছুটে গেল অ্যাথেলস্টেন। এক জনের হাত থেকে একটা কুঠার কেড়ে নিয়ে মুখোমুখি হলো ব্রায়ানের।
ভণ্ড নাইট! চিৎকার করে উঠলো অ্যাথেলস্টেন। ছেড়ে দাও মেয়েটাকে!
কুকুর! একই তেজে চিৎকার করলো টেম্পলার। তারপর আচমকা তলোয়ার তুলেই আঘাত করলো অ্যাথেলস্টেনের শিরোম্রাণহীন শিরে। কাটা গাছের মতো মাটিতে আছড়ে পড়লো স্যাক্সন রাজপুত্রের দেহ।
এসো আমার সাথে, সঙ্গীদের দিকে তাকিয়ে নির্দেশ দিলো টেম্পলার। লাফ দিয়ে ঘোড়ায় চাপলো। ছুটলো ফটক পেরিয়ে, শত্রুর ভাসানো সেতু পেরিয়ে বনের ভেতর দিয়ে।
এবার শুরু হলো দুর্গ লুটের পালা। লক্সলি তার দলবল নিয়ে প্রতিটা ঘরে ঢুকছে। মূল্যবান যা কিছু পাচ্ছে কাউকে দিয়ে পাঠিয়ে দিচ্ছে নিচের উঠানে। অবশ্য খুব ভালো করে লুট করার সুযোগ ওরা পেলো না। তার আগেই অসহ্য হয়ে উঠলো আগুনের উত্তাপ। একতলা আর দোতলার মালপত্র হাতিয়েই নেমে আসতে বাধ্য হলো সবাই।
পুরো দুর্গ এখন আগুনের রাজত্ব হয়ে উঠেছে। সবগুলো চূড়া থেকে বেরিয়ে আসছে লকলকে শিখা, কালো ধোঁয়া আর অসংখ্য ফুলকি। যুদ্ধ থেমে গেছে। বিজয়ী পক্ষ নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে দেখছে আগুনের খেলা।
শেষ; নরম্যান কুত্তাগুলোর ধুর্গ! মলে উঠলো এক দস্যু। অমনি তার সাথে গলা মিলিয়ে চিৎকার করলো আরো অনেকে: শেষ! নরম্যান কুত্তাগুলোর দুর্গ!
হঠাৎ দুর্গের সর্বোচ্চ চূড়ায় দেখা গেল শীর্ণ এক নারী মূর্তি। বুড়ি উলরিকা! তার ধূসর এলো চুল, পোশাকের প্রান্ত উড়ছে বাতাসে। তার সেই বনখনে গলায় সে গেয়ে চলেছে উদ্দীপনাময় এক যুদ্ধের গান। গান এক সময় থেমে গেল। উদ্ভ্রান্ত দৃষ্টিতে আকাশের দিকে তাকালো উলরিকা। হেসে উঠলো হো-হো করে। আগুন পৌঁছে গেছে চূড়াটায়। কিন্তু ক্ষেপ নেই বৃদ্ধার। হেসেই চলেছে সে। তার পোশাকের প্রান্ত ছুঁলো আগুন। হাসি থামলো না। সারা গায়ে আগুন ধরে গেল উলরিকার। হাসি থামলো না। উড়ন্ত চুলগুলো পুড়ে গেল। কিন্তু হাসি চলছে। নিচে দাঁড়িয়ে বিস্মিত মানুষগুলো ভাবছে, এ কি করে সম্ভব! তারপর আচমকা থেমে গেল হাসি। উলরিকার দেহটা ধীরে ধীরে পড়ে গেল ভাজ হয়ে। অগ্নিস্নানে শান্ত হলো তার এতদিনের অন্তর্জালা।
১৭. হার্ট হিল ওয়াক-এর বিশাল ওক গাছটা
পরদিন ভোর।
হার্ট হিল ওয়াক-এর বিশাল ওক গাছটার নিচে জড় হয়েছে বিজয়ী পক্ষ। লুটের মালপত্র ভাগ বাটোয়ারা হবে। দলের নেতা বনের রাজা লক্সলি। সবুজ ঘাসের ওপর বসেছে সে ডান পাশে ব্ল্যাক নাইট আর বাঁ পাশে সেড্রিককে নিয়ে।
লক্সলির কয়েকজন অনুচর দুটো ভাগে ভাগ করে সাজিয়ে রাখলো লুট করে আনা জিনিসগুলো। তারপর লক্সলি বললো, মহান সেড্রিক, লুটের মালপত্র সব দুভাগে ভাগ করা হয়েছে। আপনার যে ভাগ ইচ্ছা আপনি নিন। আপনার যেসব লোক আমাদের সাহায্য করেছে তাদের ভেতর বিলিয়ে দেবেন।
এসবের কোনো প্রয়োজন আমার নেই, বললেন সেড্রিক। তোমরা যে প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে আমাদের জীবন আর সম্মান বাঁচিয়েছে সে জন্যে তোমাদের আন্তরিক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। এর দুটো ভাগই তোমরা নাও। আমি সত্যিই খুশি হবো। আমার লোকদের আমি নিজেই পুরস্কার দেবো।