কেন! রোয়েনাকে বিয়ে করলে দোষ কি?
কিছুই না। সেড্রিক যেটা চায় না আইভানহোসেটা চায়, এ-ই দোষ। সেড্রিকের ইচ্ছা স্যাক্সন রাজকুমার অ্যাথেলস্টেনের সাথে রোয়েনার বিয়ে দেবে। যাকগে ওসব কথা, ঐ যে সেই ক্রুশ, এবার বাঁয়ে মোড় নিতে হবে।
না ডানে, প্রতিবাদ করলো নাইট টেম্পলার।
কি আশ্চর্য, ডানে কেন! সবিস্ময়ে বললেন অ্যায়মার। লোকটা তো বললো বয়ে যেতে!
হ্যাঁ। কিন্তু আমার বিশ্বাস বদমাশটা মিথ্যে বলেছে। ডানের পথ ধরে গেলেই আমরা সেড্রিকের বাড়ি পৌঁছাবো।
আমার কিন্তু তা মনে হয় না, বললেন ধর্মযাজক। একটা রূপার মুদ্রা দিয়েছি…।
ইতোমধ্যে বৃষ্টি বেশ চেপে এসেছে। সন্ধ্যাও ঘুরে গেছে অনেকক্ষণ আগে। অন্ধকারে দাঁড়িয়ে ভিজতে ভিজতে তর্ক করতে লাগলেন দুজন। হঠাৎ করেই প্রায়োরের চোখ পড়লো কুশটার গোড়ায়। বিদ্যুতের আলোয় দেখতে পেলেন একটা মানুষ পড়ে আছে সেখানে।
আরে, কে যেন পড়ে আছে ওখানে! কুশটার দিকে ইশারা করে চেঁচিয়ে উঠলেন তিনি। না কি মরে গেছে?
হুগো, বর্শার আগা দিয়ে একটা খোঁচা মারো তো ব্যাটাকে! এক ভূতের দিকে ফিরে আদেশ করলো নাইট টেম্পলার।
খোঁচা খেয়ে উঠে দাঁড়ালো লোকটা।
কী ব্যাপার? আমাকে এমন বিরক্ত করার মানে? হৈ-চৈ করে উঠলো সে। শুয়ে শুয়ে একটু চিন্তা ভাবনা করছিলাম, তার ভেতর এ কী ঝামেলা!
কিছু মনে কোরো না, প্রায়োর বললেন, স্যাক্সন সেড্রিকের বাড়িটা কোন দিকে আমরা জানতে চাই। সেজন্যে বাধ্য হয়েই তোমাকে বিরক্ত করতে হলো।
স্যাক্সন সেড্রিকের বাড়ি? আমিও তো সেখানেই যাবো। আমাকে একটা ঘোড়া দিতে পারবেন?–তাহলে আপনাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে যেতে পারি। বেশ, দিচ্ছি তোমাকে ঘোড়া, নিয়ে চলো আমাদের, বলে স্যার ব্রায়ান ভৃত্যকে আদেশ করলো তার অতিরিক্ত ঘোড়াটা ওকে দিতে।
ঘোড়ায় চাপলো লোকটা। এবং ওয়াম্বা যে দিকের কথা বলেছিলো তার উল্টোদিকে যেতে শুরু করলো। অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে প্রায়োরের দিকে তাকালেন নাইট টেম্পলার। যেম বোঝাতে চাইলেন, কেমন, বলেছিলাম না ডান দিকেই যেতে হবে?
কিছুক্ষণ পর তারা পায়ে চলা পথ বেয়ে বনের ভেতর ঢুকলেন। কয়েকটা ছোট ছোট নালা পেরোলেন। তারপর বড় রাস্তায় উঠলেন।
নিঃশব্দে পথ চলছেন সবাই। হঠাৎ লোকটা বললো, আর কিছুদূর গেলেই সেড্রিকের বাড়ি।
এতক্ষণ নীরব থাকলেও ভেতরে ভেতরে কৌতূহলে মরে যাচ্ছিলেন ধর্মযাজক। এবার আর চুপ করে থাকতে পারলেন না। লোকটার পরিচয় জিজ্ঞেস করলেন।
আমি একজন তীর্থযাত্রী, জবাব দিলো লোকটা। সবে তীর্থ করে ফিরেছি পবিত্র ভূমি জেরুজালেম থেকে।
যুদ্ধে না জেতা পর্যন্ত ওখানে থাকলেই ভালো হতো না? প্রশ্ন করলো টেম্পলার।
হাসলো লোকটা। স্যার নাইট ঠিকই বলেছেন। তবে কথা হলো গিয়ে, যারা ঈশ্বরের নামে শপথ নিয়ে ক্রুসেডে যোগ দিয়েছিলেন তাঁরাই যখন যুদ্ধক্ষেত্র থেকে এত দূরে চলে এসেছেন তখন আমার মতো একজন সাধারণ তীর্থযাত্রী ওখানে থাকলেই কি উপকার হতো, না থাকলেও বা কি ক্ষতি হবে?
চোখ মুখ লাল হয়ে উঠলো স্যার ব্রায়ানের। অভ্যাসবশেই যেন হাত চলে গেল চাবুকের ওপর। এবারও তাকে বাধা দিলেন প্রায়োর। ফিসফিস করে বললেন, থামুন তো, কি করছেন বার বার! লোকটার দিকে তাকিয়ে যোগ করলেন, তুমি তো এখানকার পথঘাট ভাললাই চেনো মনে হচ্ছে। যেভাবে বনের ভেতর দিয়ে নিয়ে এলে!
এ এলাকায়ই আমার জন্ম, জবাব দিলো তীর্থযাত্রী। বড়ও হয়েছি এখানে।…আমরা এসে গেছি। সামনের বাড়িটাই সেড্রিকের।
ঝড় এখনো তেমন মারাত্মক চেহারা নেয়নি, তবে বৃষ্টি পড়ছে মুষলধারে। সেড্রিকের বাড়িটা দেখামাত্র খুশি হয়ে উঠলো সবাই।
বিরাট জায়গা নিয়ে বাড়ি। লম্বা, নিচু একটা দালান; সামনে পেছনে অনেকগুলো উঠান। নরম্যান দুর্গবাড়ি সাধারণত যেমন হয় তেমন নয়। তাই বলে অরক্ষিতও নয়। নিরাপত্তা ব্যবস্থা মোটেই দুর্বল নয় বাড়িটার। চারদিকে জল ভর্তি পরিখা। বাড়িতে ঢোকার একমাত্র পথ একটা ঝুলসেতুর ওপর দিয়ে। ফটক খুলে সেতু নামিয়ে দিলে লোকজন ভেতরে ঢুকতে পারে, সেতু উঠিয়ে রাখলে কারো পক্ষে ঢোকা সম্ভব নয়। পরিখা সাঁতরে ঢোকার আশা বৃথা, কারণ জলের ভেতর থেকেই পাড়া উঠে গেছে উঁচু পাথরের প্রাচীর।
ঝুলসেতুর সামনে দাঁড়িয়ে পড়লো দলটা। নিজেদের উপস্থিতি ঘোষণা করার জন্যে উচ্চৈস্বরে শিঙা বাজাতে লাগলো নাইট টেম্পলার ব্রায়ান। ভিজে কাকের মতো অবস্থা সবার। এখন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ছাদের আশ্রয় চাই।
————–
* টেম্পল-এর খেতাব পাওয়া নাইট অর্থাৎ নাইট টেম্পলাররা যতটা না সৈনিক তার চেয়ে বেশি পুরোহিত। সাধারণত সাত বংশের সন্তানরা এই খেতাব পেতো। কৃচ্ছসাধনের মাধ্যমে সাদাসিধা জীবনযাপন এবং প্যালেস্টাইনের পবিত্র ভূমি উদ্ধারের জন্যে আমৃত্যু যুদ্ধ করার শপথ নিতে হতো তাদের। টেস্-এর নাইট হতে পারাটা সে যুগে অত্যন্ত সম্মানের ব্যাপার ছিলো। ইউরোপের সকল অংশের খ্রীষ্টানই এই খেতাব পাবার যোগ্য বলে বিবেচিত হতো। মি দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, সব নাইট টেম্পলার তাদের শপথ রক্ষা করতো না। সৈনিক হিশেবে যোগ্য হলেও কৃচ্ছসাধনের ব্যাপারে তাদের আগ্রহ ছিলো কম। ভোগবিলাসের জীবন কাটাতেই তারা পছন্দ করতো। অনেকে সাধারণ মানুষের সাথে রীতিমতো নিষ্ঠুর আচরণ করতেও পিছপা হতো না।
০২. খাওয়ার সময় হয়ে গেছে
খাওয়ার সময় হয়ে গেছে। রদারউডের জমিদার স্যাক্সন সেড্রিক বসে আছেন তার বাবার ঘরে।