বিনাবাক্যব্যয়ে চলে গেল লক্সলি শখানেক লোক নিয়ে। ইতোমধ্যে প্রধান ফটক বরাবর পরিখার জলে ভাসানো হয়ে গেছে সেতু। কিন্তু ব্যাপারটা দেখে ফেলেছে দুর্গের লোকরা। সব কাজ ফেলে সেতুটাকে ধ্বংস করার চেষ্টা করতে লাগলো তারা। বড় বড় পাথর, গাছের গুঁড়ি ফেলতে লাগলো ওপর থেকে। কিন্তু দুর্ভাগ্য তাদের, সেতুটার বিশেষ কোনো ক্ষতি করার আগেই দুর্গের পেছন দিক থেকে চিকার ভেসে এলো: এদিক দিয়েও হামলা করছে ওরা!
মুহূর্তে স্তব্ধ হয়ে গেল নরম্যানরা। বোয়া-গিন্সবার্ট ঠোঁট কামড়ে দাঁড়িয়ে রইলো কয়েক মুহূর্ত। জিজ্ঞেস করলো, এবার, দ্য ব্রেসি?
কিছু লোককে পেছনে পাঠিয়ে দেয়া ছাড়া আর তো কোনো উপায় দেখছি না।
হঠাৎ ব্ল্যাক নাইট খেয়াল করলো দেয়ালের ওপর শত্রু-সংখ্যা অর্ধেকে নেমে এসেছে। কৌশলটা তাহলে কাজে লেগেছে, মুচকি হেসে মনে মনে ভাবলো সে।
সেড্রিক আর কয়েকজন ডাকাতকে নিয়ে সেতুর ওপর দিয়ে এগোলো ব্ল্যাক নাইট। গাছের গুঁড়ি এখন আর পড়ছে না ওপর থেকে, পড়ছে কেবল পাথর, তারও সংখ্যা কমে গেছে অনেক। ঢালটা মাথার ওপর তুলে ধরে এগোচ্ছে সে, পাথর থেকে মাথা বাঁচানোর জন্যে কয়েক সেকেন্ডের ভেতর সেতু পার হয়ে দরজার কাছে পৌঁছে গেল নাইট।
এদিকে উলরিকা তার কাজ করে যাচ্ছে নিষ্ঠার সাথে। ফ্ৰঁত দ্য বোয়েফের ঘরে তালা লাগিয়ে দিয়ে এসে একে একে দুর্গের অন্য ঘরগুলোতে আগুন লাগাচ্ছে সে। এক তলার পর দোতলা, দোতলার পর তিনতলা। তারপর আরো ওপরে।
প্রধান ফটকের ভারি কপাট ভেঙে ফেলার চেষ্টা করছেন ব্ল্যাক নাইট ও সেড্রিক। দুজনের হাতে দুটো কুঠার। সর্বশক্তিতে তারা ঘা মেরে চলেছেন কাঠের কপাটে। এদিকে এক দল লোককে দুর্গের পেছন দিকে পাঠিয়ে দিয়ে সবে মাত্র আবার দেয়ালের ওপর উঠেছে দ্য ব্রেসি। ব্ল্যাক নাইট ও সেড্রিকের প্রচেষ্টা দেখতে পেলো সে। অমনি নিজের লোকদের দিকে তাকিয়ে খেঁকিয়ে উঠলো, লজ্জা করে না তোমাদের, মাত্র এই কজন লোককে ঠেকাতে পারোনি! সৈনিক বলে আবার গর্বে মাটিতে পা পড়ে না। হাঁ করে দেখছে কি? তাড়াতাড়ি ফটকের ওপরের দেয়ালটা ভেঙে ফেল। ইট পাথরের নিচে চাপা পড়ে মরবে বদমাশগুলো! বলতে বলতে নিজেই একজনের হাত থেকে একটা কুঠার কেড়ে নিয়ে দেয়াল আলগা করতে লাগলো।
ইতোমধ্যে যাদের নিয়ে গিয়েছিলো তাদের দুর্গের পেছন দিকে রেখে আবার সামনে চলে এসেছে ললি। সে খেয়াল করলো বিপদটা। ঝটপট কাঁধ থেকে ধনুক খুলে দ্য ব্রেসিকে লক্ষ্য করে বেশ কয়েকটা তীর ছুঁড়লো সে। কি দ্য ব্রেসির গায়ে ইস্পাতের বর্ম থাকায় বিধলো না একটাও।
পিছিয়ে আসুন, সেড্রিক। পিছিয়ে আসুন, নাইট, চিৎকার করে উঠলো নিরুপায় লক্সলি।
কিন্তু দুজনের কেউই সে চিৎকার শুনতে পেলেন না। এত জোরে তারা কুঠার চালাচ্ছেন যে সে শব্দের নিচে চাপা পড়ে যাচ্ছে অন্য সব আওয়াজ। তাদের মাথার ওপর পাথরের গাঁথুনি তখন কাঁপতে শুরু করেছে। যে কোনো মুহূর্তে খসে পড়বে।
এই সময় বোয়া-গিলবার্টের চিৎকার শুনে থেমে গেল দ্য ব্রেসি।
আগুন! আগুন! দুর্গে আগুন লেগেছে!
কুঠারটা নামিয়ে রেখে বোয়া-গিলবার্টের কাছে ছুটে গেল দ্য ব্রেসি।
এবার, ব্রায়ান? হাঁপাতে হাঁপাতে বললে সে। এবার আমরা কি করবো?
ফটক খুলে ওদের ঐ সেতুর ওপর দিয়ে পালাতে হবে। এছাড়া আর কোনো পথ নেই।
নির্দেশ পাওয়া মাত্র পড়িমরি করে নেমে আসতে লাগলো নরম্যানরা দেয়ালের ওপর থেকে। তারপর সবাই একজোট হয়ে ছুটলো ফটকের দিকে।
ব্ল্যাক নাইটের সামনাসামনি পড়ে গেল দ্য ব্রেসি। শুরু হলো ভয়ঙ্কর লড়াই। প্রথম কিছুক্ষণ সমানে সমানে লড়লো দুজন। তারপর ধীরে ধীরে পিছাতে শুরু করলো দ্য ব্রেসি। হঠাৎ মাথায় ব্ল্যাক নাইটের কুঠারের প্রচণ্ড এক আঘাতে পড়ে গেল সে।
হার স্বীকার করো, দ্য ব্রেসি! চিৎকার করে উঠলো নাইট।
কক্ষনো না! মরি তা-ও ভাললা! পাল্টা চিৎকার করলো দ্য ব্রেসি।
ব্ল্যাক নাইট ঝুঁকে দ্য ব্রেসির কানে কানে কি যেন বললো। অমনি নরম হয়ে এলো দ্য ব্রেসির গলা।
জি, আমি হার স্বীকার করছি? বললো সে।
যাও দেয়ালের ওপাশে গিয়ে অপেক্ষা করো, ব্ল্যাক নাইট বললো। আমার নির্দেশ না পাওয়া পর্যন্ত নড়বে না।
জি, যাচ্ছি। উঠে দাঁড়ালো দ্য বেসি। বললো, আইভানহে বন্দী হয়ে আছে এ দুর্গে। ওকে বাঁচাতে হলে উপরে উঠে যান। উপরের একটা ঘরে ওকে আটকে রাখা হয়েছে।
.
আইভানহোর ঘরেও ধোঁয়া ঢুকতে শুরু করেছে। কুণ্ডলী পাকানো ঘন কালো ধোঁয়া। রেবেকা আর সে–কাশছে দুজনেই।
আমার কথা ভেবো না, রেবেকা, মিনতি করলো আইভানহো, তুমি চলে যাও। প্রাণ বাঁচাও।
না, দৃঢ় কণ্ঠে জবাব দিলো রেবেকা। বাচি মরি, দুজন এক সাথেই থাকবো।
না, রেবেকা, আমার কথা শোনো। আগুন সারা দুর্গে ছড়িয়ে পড়ার আগেই…
শেষ করতে পারলো না আইভানহো, দড়াম করে খুলে গেল দরজা। বোয়া-গিলবার্ট ঢুকলো। তার বর্ম ভেঙে গেছে। জায়গায় জায়গায় লেগে আছে ছোপ ছোপ রক্ত।
সারা দুর্গে ছড়িয়ে পড়েছে আগুন, হাঁপাতে হাঁপাতে বললো সে। তার ভেতর দিয়ে আমি এসেছি, রেবেকা, শুধুমাত্র তোমাকে বাঁচাতে। চলো আমার সাথে।
তার চেয়ে মরবো আমি।
সময় নষ্ট করলো না টেম্পলার। সোজা এগিয়ে এসে কাঁধে তুলে নিলো ওকে। প্রাণপণে চিৎকার করতে করতে ব্রায়ানের পিঠে কিল ঘুসি মেরে চললে রেবেকা। ক্ৰক্ষেপ করলো না বোয়া-গিলবার্ট। বেরিয়ে গেল ঘর ছেড়ে। এদিকে অসহায় আইভানহোও চিৎকার করছে। তার চিৎকার শুনে ঘরের দরজায় এসে দাঁড়ালো ব্ল্যাক নাইট।