আমাদের লোকরা পিছু হটে যাচ্ছে? উদ্বিগ্ন কণ্ঠে প্রশ্ন করলো আইতানহো।
না! না! ব্ল্যাক নাইট সমানে ঘা মেরে চলেছে বাইরের মিনারের দরজার ওপর। ওহ্ কি একেকটা ঘা! ওপর থেকে বড় বড় পাথর ছুঁড়ে মারছে তার ওপর। কিন্তু তবু এখনো সে টিকে আছে। দরজার পাল্লাগুলা কাঁপছে। এই ভেঙে পড়লো। আমাদের লোকরা ছুটে আসছে খোলা দরজার দিকে!
ওরা কি পরিখা পার হচ্ছে?
না, বুলসেতুটা ভেঙে দিয়েছে বোয়া-গিলবার্ট। ওরা বাইরের মিনার দখল করে নিয়েছে। ঢুকে পড়েছে ভেতরে। আরে, লড়াই দেখি থেমে গেল!
আবার আক্রমণ করার জন্যে তৈরি হচ্ছে ওরা, বললো আইভানহো। বিশ্রাম নিচ্ছে সৈনিকরা। ওহ, আমি যদি ব্ল্যাক নাইটের পাশে দাঁড়িয়ে লড়তে পারতাম! আমার দশ বছরের আয়ু ছেড়ে দিতে রাজি সেজন্যে।
হায়, নাইট! দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো রেবেকা। যার জন্যে আপনি দশ বছরের পরমায়ু ছেড়ে দিতে চাইছেন তা থেকে পাবেন কী? গৌরব? কিন্তু কী এই গৌরব? এ তো কবরের মাথায় পাথরে খোদাই করা কথা; কয়েকদিন পরেই যা আর কারো মনে থাকে না।
আইভানহোর দিকে তাকালো রেবেকা। যন্ত্রণা আর উত্তেজনায় ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে গেছে সে।
ঘুমাচ্ছে, ফিস ফিস করে বললো রেবেকা। ওহ, বাবা! কী অকৃতজ্ঞ মেয়ে আমি! এই যুবকের সোনালি চুল দেখে ভুলে গেছি তোমার ধূসর চুলের কথা। কিন্তু আর নয়, আমার অন্তর থেকে এই বোকামির শিকড় আমি উপড়ে ফেলবো। মাথার ওপর ঘোমটা টেনে দিয়ে জানালার কাছে গিয়ে বসলো সে।
.
মৃত্যুশয্যায় শুয়ে আছেন্টরকুইলস্টোন। প্রাসাদের মহা প্রতাপশালী অধিপতি রেজিনাল্ড ফ্রঁত দ্য বোয়েফ। মৃত্যু একেবারে ঘাড়ের ওপর এসে গেছে বুঝতে পেরে আতঙ্কিত বোধ করছে সে। শূন্য একটি কক্ষে তাকে ফেলে রেখে গেছে তার বন্ধু ও ভৃত্যরা। নিয়তির কি নির্মম লিখন, মৃত্যু যখন ঘরের দুয়ারে পৌঁছে গেছে তখন কারও এক মুহূর্তের ফুরসত নেই তার পাশে এসে বসার। একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললো রেজিনাল্ড। কেন যেন একটা কথাই ওর মনে হচ্ছে, জীবনটা অপব্যয় হলো। কত কিছু করার ছিলো, করতে পারতো, কিন্তু কিছুই করা হলো না।
হঠাং ঘরের এক কোনা থেকে খনখনে গলায় কে যেন অট্টহাসি হেসে উঠলো।
কে? চমকে প্রশ্ন করলো রেজিনাল্ড। কে ওখানে?
তোমার যম, জবাব দিলো উলরিকা।
ভাগগা এখান থেকে ডাইনী বুড়ি। আমাকে শান্তিতে মরতে দাও।
বললেই হলো। সারা জীবনে যত অপকর্ম করেছে সব তোমাকে স্মরণ করিয়ে দেয়ার জন্যে এসেছি। আমার কাজ শেষ করি আগে তারপর যাবো।
নরকের কীট, দূর হ এখান থেকে!
না! শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত আমি তোমাকে জ্বালাবো। দুর্গাধিপতি, হাহ, দুর্গাধিপতি! পরের জিনিস ডাকাতি করে নিয়ে উনি অধিপতি হয়েছেন! শ্রুত দ্য বোয়েফ, মনে পড়ে, কত লোক তোমার হাতে মরেছে এই দুর্গে? কত অভাগার আর্তনাদে ভারি হয়ে আছে এখানকার বাতাস? মনে পড়ে উলফগ্যাঞ্জারের মুখ? আমার ভাইদের মুখ?
ওহ, থাম রাক্ষুসী! থাম!
পারলে উঠে এসে থামাও না, মহামান্য রেজিনাল্ড ট্রুত দ্য বোয়েফ ওরফে দুর্গাধিপতি। ঐ যে শুনছো, তোমার দুর্গের দেয়াল ভেঙে পড়ছে।
মিথ্যে কথা! অত্যন্ত মজবুত আমার দেয়াল। ঐ গুণ্ডাগুলোর ঘায়ে ভাংতেই পারে না। আমার লোকরা সাহসের সাথে লড়ছে! লড়ছে বোয়াগিলবার্ট, দ্য ব্রেসি। ওরা কিছুতেই হার স্বীকার করবে না!
হা-হা করে পাগলের মতো হেসে উঠলো উলরিকা। কোনো গন্ধ পাচ্ছো, রেজিনাল্ড? ধোঁয়ার গন্ধ? এর নিচের ঘরটায় জ্বালানী কাঠ রাখা হয় মনে আছে?
কি করেছিস তুই, ডাইনী বুড়ি?
কাঠের স্তূপে তেল ঢেলে আগুন লাগিয়ে দিয়েছি। হ্যাঁ, রেজিনান্ড, আমার এই দুর্বল হাত দুটো তোমার দুর্ভেদ্য দুর্গে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। ঐ দেখ, জানালা দিয়ে দেখা যাচ্ছে আগুনের লকলকে শিখা।
উঠে বসার চেষ্টা করলোত দ্য বোয়েফ। পারলো না।
রাক্ষুসী! পিশাচী! দুর্বল কণ্ঠে উচ্চারণ করলো সে। উহ, এক মুহূর্তের জন্যে যদি আবার আগের সেই শক্তি ফিরে পেতাম! তাহলে হয়তো বীরের মতো মরতে পারতাম!
বীরের মৃত্যু! আর আঁশা পেলে না। তোমার মৃত্যু হবে পথের কুকুরের মতো। বুঝলে, পথের কুকুরের মতো। প্রাই যুদ্ধে ব্যস্ত। আগুনের দিকে মন দেয়ার সুযোগই কেউ পাবে না। তুমি পুড়ে মরবে, রেজিনাল্ড! পুড়ে মরবে! হা! হা! হা!
দ্রুত পায়ে বেরিয়ে গিয়ে দরজায় তালা লাগিয়ে দিলো উলরিকা।
বাঁচাও! বাঁচাও! চিৎকার করতে লাগলো ফ্ৰঁত দ্য বোয়েফ। কিন্তু কেউ শুনতে পেলো না তার চিৎকার।
ধোঁয়ার কুণ্ডলী ঘন হয়ে ঘরে ঢুকতে শুরু করেছে। আগুনের লেলিহান শিখাও এগিয়ে আসছে ক্রমশ।
.
সংক্ষিপ্ত বিশ্রাম শেষে আবার আক্রমণ করলো ডাকাতবাহিনী। নষ্ট করার মতো সময় তাদের হাতে নেই। নরম্যানদের নিশ্বাস ফেলার সুযোগটুকুও দেয়া চলবে না। যত যা-ই হোক ওরা আছে দুর্গের ভেত্বর, উন্নত অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে। সময় পেলেই ওর নতুন করে প্রস্তুতি নেয়ার সুযোগ পাবে। তাছাড়া ওদের জন্যে যেকোনো মুহূর্তে সাহায্যও এসে যেতে পারে যেকোনো দিক থেকে।
সংক্ষিপ্ত বিশ্রামের ফাঁকে একটা ভাসমান সেতু তৈরি করে ফেলেছে ওরা। পরিখার জলৈ সেতুটা ভাসিয়ে দেয়ার নির্দেশ দিয়ে লক্মলির দিকে তাকালো ব্ল্যাক নাইট।
লক্সলি, কিছু লোক নিয়ে তুমি দুর্গের পেছন দিকে চলে যাও। নরম্যানরা যেন ভাবে ওদিক দিয়েও আমরা আক্রমণ কররো। ওদের অন্তত অর্ধেক লোক তাহলে পেছন দিকটা সামলাতে ব্যস্ত হয়ে পড়বে। এই ফাঁকে আমরা প্রধান ফটকটা ভেঙে ফেলতে পারবো।