আইভানহোই ওকে পাঠিয়েছিলো পাদ্রীকে ডেকে আনার জন্যে। কিন্তু উলরিকার তাড়া খেয়ে ফিরে এসেছে ব্যর্থ হয়ে। এর খানিক বাদেই নিচে উঠানে শুরু হলো ভয়ানক কোলাহল। সশস্ত্র মানুষের ভারি পায়ের শব্দ শোনা যেতে লাগলো অলিপথগুলোয়। দেয়ালের ওপর থেকে ভেসে আসতে লাগলো নাইটদের উচ্চকণ্ঠের নিশ। শুনছে আইভানহো। আর অস্থির হয়ে উঠছে ভেতরে ভেতরে। যুদ্ধের ঘোড়া রণদামামা শুনে যেমন করে তেমন ছটফট করছে সে। ইচ্ছে করছে ছুটে গিয়ে যোগ দেয় যুদ্ধে। কিন্তু ওর শরীরের যা অবস্থা তাতে তা অসম্ভব এক কথায়।
অবশেষে সে বলেই ফেললো, কোনো রকমে যদি ঐ জানালার ধারে গিয়েও বসতে পারতাম! যুদ্ধে যোগ দিতে না পারলেও দেখতে পারতাম অন্তত।
হঠাৎ সব শব্দ থেমে গেল যেন কারো ইঙ্গিতে। গভীর নিস্তব্ধতা দুর্গ জুড়ে।
খামোকাই আপনি দুঃখ পাচ্ছেন, মাননীয় নাইট, রেবেকা বললো। দেখুন সব গোলমাল থেমে গেছে। যুদ্ধ হয়তো হবেই না।
তুমি কিছু জানো না, অস্থির কণ্ঠে বললো আইভানহো। গোলমাল থেমে গেছে মানে এপক্ষের সবাই যার যার জায়গায় দাঁড়িয়ে গেছে তৈরি হয়ে। আক্রমণের জন্যে অপেক্ষা করছে। দেখবে একটু পরেই যুদ্ধ শুরু হবে। আহ, আমি যদি জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়াতে পারতাম! বলতে বলতে বিছানা থেকে ওঠার চেষ্টা করলো আইভানহো। কিন্তু পারলো না। শুয়ে পড়লো আবার।
তাড়াতাড়ি রেবেকা বললো, আপনি উঠবেন না। আমি জানালার ধারে দাঁড়াচ্ছি। যা দেখবো, আপাকে বলবো।
না, না, ভুলেও তা কোরো না, শঙ্কিত কণ্ঠে বললো আইভানহো। এই দুর্গের প্রতিটি জানালা, প্রতিটি ফোকর এখন আক্রমণকারীদের লক্ষ্য। আচমকা একটা তীর এসে হয়তো লাগবে তোমার গায়ে।
যদি লাগে তো লাগুক না। বেঁচে যাই তাহলে, বলতে বলতে জানালার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো রেবেকা।
আইভানহো জানে ইচ্ছে করলেও ও বাধা দিতে পারবে না। তাই শেষ পর্যন্ত মিনতিভরা কণ্ঠে বললো, ঠিক আছে, যদি দাঁড়াতেই চাও, এমনভাবে দাঁড়াও যেন বাইরে থেকে তোমাকে না দেখা যায়।
আইভানহোর অনুরোধ রাখলো রেবেকা। এক পাশে সরে এলো।
আরে, কয়েকশো লোক এগিয়ে আসছে! হঠাৎ চিৎকার করে উঠলো সে। সবার গায়ে সবুজ পোশাক, হাতে তীর ধনুক।
কোন পতাকার অধীনে আছে ওরা?
কোনো পতাকাই তো দেখতে পাচ্ছি না।
আশ্চর্য! দলের নেতৃত্ব দিচ্ছে কে কে? দেখতে পাচ্ছো?
একজনকেই দেখে মনে হচ্ছে নেতা। তার গায়ে কালো বর্ম।
ঢালের ওপর কি চিহ্ন দেখ তো।
উহুঁ, দেখতে পাচ্ছি না। ঢালটার রঙও কালো, আর কিছু বোঝা যাচ্ছে। সূর্যের আলো পড়ে ঝলকে উঠছে ওটা। এক মুহূর্ত থেমে রেবেকা আবার বললো, প্রায় এসে গেছে। সামনের লোকগুলো কাঠের ঢাল দিয়ে মাথা ঢেকে ফেলেছে। পেছনের ওরা ধনুকে তীর পরাচ্ছে। ওহ, ঈশ্বর, এবার কি হবে?
তীক্ষ্ণস্বরে শিঙা বেজে উঠলো একবার। আক্রমণের সংকেত! দুর্গ প্রাচীরের ওপর থেকে ভেসে এলো ঢাকের আওয়াজ।
শুরু হয়ে গেল যুদ্ধ।
একটু পরপরই চিৎকার শোনা যাচ্ছে, ফ্রত দ্য বোয়েফ! বোয়াগিলবার্ট! দ্য ব্রেসি!
শয়ে শয়ে তীর এসে লাগছে দুর্গের দেয়ালে। শয়ে শয়ে উড়ে গিয়ে পড়ছে আক্রমণকারীদের ওপর।
কি দেখতে পাচ্ছো, রেবেকা? জিজ্ঞেস করলো আইভানহো।
বৃষ্টির মতো তীর ছুটছে, আর কিছু না।
ও বেশিক্ষণ চলবে না। শুধু তীর ছুঁড়ে এ দুর্গের একটা পাথরও খসানো যাবে না। দেয়ালের ওপর হামলা চালাতে হবে। সেই ব্ল্যাক নাইটকে দেখতে পাচ্ছো? কি করছে এখন?
কই, দেখছি না তো তাকে।
ব্যাটা কাপুরুষ! চিৎকার করলো আইভানহো। তীরের ভয়েই পেছনে চলে গেছে!
না, না, আবার তাকে দেখতে পাচ্ছি। কয়েক জনকে সাথে নিয়ে দেয়ালের ওপর হামলা চালিয়েছে, তার হাতে কুঠার। অন্যদের হাতে গাছের গুঁড়ি। দমাদম চালাচ্ছে দেয়ালের গায়ে। দেয়ালের গায়ে গর্ত করে ফেলেছে ওরা! কয়েকজন ঢুকতে যাচ্ছে সেই ফোকর গলে! নাহ্! পিছিয়ে গেল! হতাশ শোনালো রেবেকার কণ্ঠস্বর। ফ্ৰঁত দ্য বোয়েফ ওদের পেছনে তাড়া করছে। হাতাহাতি যুদ্ধ হচ্ছে এখন! ওহ, কি ভয়ঙ্কর! জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে দিয়েছে রেবেকা। দেয়ালের কোল ঘেঁষে যে লড়াই হচ্ছে তার কিছু সে দেখতে পাচ্ছে না।
: তারপর রেবেকা? প্রশ্ন করলো আইভানহো। এখন কি হচ্ছে?
ফ্ৰঁত দ্য বোয়েফ আর সেই ব্ল্যাক নাইট মুখখামুখি লড়ছে। ওহ্ ঈশ্বর, বাঁচাও ওকে! পড়ে গেছে।
কে পড়ে গেছে, রেবেকা? তাড়াতাড়ি বলো!
ব্ল্যাক নাইট, মিইয়ে যাওয়া গলায় বললো রেবেকা। পর মুহূর্তে আবার সতেজ হয়ে উঠলো সে। না আবার উঠে দাঁড়িয়েছে, তলোয়ার ভেঙে গেছে ওর। একজনের হাত থেকে কুঠার কেড়ে নিয়েছে। ওহ, মা গো! পড়ে গেছে।
কে, রেবেকা? কে?
ফ্ৰঁত দ্য বোয়েফ! ওর লোকজন দৌড়ে যাচ্ছে ওকে উদ্ধার করার জন্যে। বোয়া-গিলবার্ট ওদের সামনে। টানতে টানতে ওরা নিয়ে আসছে ফ্ৰঁত দ্য বোয়েফকে। দেয়ালের ভেতর চলে এসেছে। দম নেয়ার জন্যে থমলো রেবেকা।
তারপর, রেবেকা? তারপর?
বাইরের ওরা মই লাগাচ্ছে দেয়ালের গায়ে! উঠে আসছে! নরম গুলো তেল ছুঁড়ে মারছে, পাথর ছুঁড়ে মারছে। কয়েকজন একটা গছের গুঁড়ি নিয়ে এসেছে এই ছুঁড়ে দিলো। ঔড়ির তলে পড়ে চিড়ে চ্যাপ্টা হয়ে গেল কয়েকজন ডাকাত। আরো কয়েকজন এগিয়ে আসছে ওদের জায়গা নেয়ার জন্যে। কিন্তু…কিন্তু, পারছে না ওর। মইগুলো সব ফেলে দিয়েছে নরম্যানরা।