না! না! আমি তোমাকে ঘৃণা করি। থুতু দেই তোমার মুখে! আর এগিও না!
স্পষ্ট ভীতি ফুটে উঠেছে রেবেকার চোখে মুখে। এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। আর দুতিন পা এগোলেই ওকে ধরে ফেলবে বোয়া-গিলবার্ট! কি করবে কিছু বুঝতে পারছে না রেবেকা। শ্বাস প্রশ্বাস দ্রুত হয়ে উঠেছে ওর আতঙ্কে। হঠাৎ চোখ পড়লো জানালাটার ওপর। তখন যে খুলেছিলো আর বন্ধ করেনি। আচমকা দুই লাফে ছুটে গিয়ে ও উঠে দাঁড়ালো চৌকাঠের ওপর। ওখান থেকে লাফ দিলেই পড়বে নিচের বাঁধানো চত্বরে–তার অর্থ অবশ্যম্ভাবী মৃত্যু!
ব্যাপারটা এত দ্রুত ঘটে গেল যে, বাধা দেয়ার সামান্যতম সুযোগও পেলো না টেম্পলার। হতবুদ্ধি হয়ে কয়েক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে রইলো সে। তারপর এগোলো জানালার দিকে। অমনি চিৎকার করে উঠলো রেবেকা, যেখানে আছে সেখানেই দাঁড়াও, নাইট টেম্পলার! আর এক পা এগিয়েছো কি আমি লাফিয়ে পড়বে।
ব্রায়ান কোনদিন, কোনো পরিস্থিতিতেই তার সংকল্প থেকে পিছু হটেনি। কারো অনুনয়-বিনয় বা দুঃখ-কষ্টে তার মন কখনো গলেনি। কিন্তু আজ রেবেকার সাহস ও মানসিক শক্তি দেখে গললো। রীতিমতো মুগ্ধ হয়ে গেল টেম্পলার। কোমল কণ্ঠে বললো, এসো এসো, রেবেকা। এমন পালগামি করে না। কথা দিচ্ছি তোমার কোনো ক্ষতি আমি করবো না।
কথা দিচ্ছো! তোমার কথা আমি বিশ্বাস করি না!
তুমি আমার ওপর অবিচার করছে, রেবেকা। সত্যিই বলছি, আমি তোমার কোনো ক্ষতি করবে না। তোমার নিজের জন্যে না হোক তোমার বুড়ো বাবার কথা ভেবে অন্তত আমার কথা বিশ্বাস করো। সে-ও এই দুর্গে বন্দী, আমি পাশে দাঁড়ালে কেউ তার কোনো ক্ষতি করতে পারবে না।
এবার একটু নরম হলো রেবেকার মন।
তোমাকে বিশ্বাস করবো? ইতস্তত করছে সে। বুঝতে পারছি না ঠিক হবে কিনা…।
শোনো রেবেকা, জীবনে অনেক বেআইনী কাজ আমি করেছি, অনেক অধর্মাচরণ করেছি, কিন্তু কথার খেলাপ কখনো করিনি।
বেশ, বিশ্বাস করলাম। কিন্তু যেখানে আছে সেখান থেকে তুমি এক পা-ও এগোবে না, তাহলে আবার আমি বিশ্বাস হারাবো।
আমাদের মধ্যে তাহলে সন্ধি হলো, রেবেকা। আমার আপত্তি নেই। কিন্তু শর্ত হলো আমাদের মাঝে এই দূরত্ব ঠিক রাখতে হবে। তুমি এক চুলও এগোতে পারবে না।
বেশ, দূরেই থাকবো, তবু তুমি আমাকে ভয় পেও না।
আমি তোমাকে ভয় পাইও না। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ, আমার মনের জোর নষ্ট হয়নি।
এখনও তুমি আমার উপর অবিচার করছে, রেবেকা। অনুযোগের সুর ব্রায়ানের কণ্ঠে। আমার উপর থেকে তোমার সন্দেহ এখনও যাচ্ছে না। আমাকে যত খারাপ ভাবছো, সত্যিই আমি তত খারাপ নই…।
এই সময় বাইরে থেকে ভেসে এলো ট্রাম্পেটের তীক্ষ্ণ আওয়াজ। ব্যস্ত হয়ে উঠলো ব্রায়ান। নিশ্চয়ই কোনো দুঃসংবাদ।
…যাক এ নিয়ে আমরা পরে আবার আলাপ করবো। এখন যাই।
তোমার সাথে যে রূঢ় আচরণ করেছি সেজন্যে ক্ষমা চাইব না। কারণ ঐ আচরণ না করলে তোমার এই কোমল দেহে এমন বজ্রকঠিন একটা মন লুকিয়ে আছে তা বোধ হয় জানতে পারতাম না। শিগগিরই আবার আমাদের দেখা হবে, ততক্ষণ আমার কথাটা একটু ভেবে দেখ।
বেরিয়ে গেল ব্রায়ান। জানালার ওপর থেকে নেমে এলো রেবেকা! ধপ করে বসে পড়লো মেঝেতে। এই এক কৌশলে কবার বাঁচা যাবে, ভাবছে ও।
১৪. দ্রুত পায়ে সিঁড়ি বেয়ে
দ্রুত পায়ে সিঁড়ি বেয়ে নেমে এলো টেম্পলার বোয়া-গিলবার্ট। দুর্গের হলঘ ঢুকে দেখলো দ্য ব্রেসি ইতোমধ্যেই সেখানে পৌঁছে গেছে। একটু পরেই দুর্গাধিপতি রেজিনাল্ড ট্রুত দ্য বোয়েফও এলো। একটা চিঠি তার হাতে।
দেখি কি লিখেছে এতে, কে, বললো রেজিনান্ড। চিঠিটা খুলে মেলে ধরলো চোখের সামনে। কিন্তু পড়তে পারলো না। স্যাক্সন ভাষায় লেখা ওটা। দ্য ব্রেসির দিকে তাকালো সে। দেখ তো পড়তে পার কি না।
দ্য ব্রেসিও পড়তে পারলো না।
দাও দেখি আমার কাছে, বললো টেম্পলার। স্যাক্সন ভাষা অল্প স্বল্প বুঝি আমি। চিঠিটা নিয়ে পড়তে শুরু করলো সে। তার পরেই সবিস্ময়ে চিৎকার করে উঠলো, আরে, এ যে দেখছি ভয় দেখিয়ে লিখেছে–নাকি ঠাট্টা?–কিছু তো বুঝতে পারছি না!
ঠাট্টা! আমার সাথে! চিৎকার করলো ত দ্য বোয়েফ। জোরে পড় তো। কার এত বড় সাহস, আমার সাথে ঠাট্টা করে!
টেম্পলার পড়তে লাগলো :
রদারউডের মহান জমিদার সেড্রিকের ভাঁড় ওয়াম্বা ও শুয়োর পালক গার্থ, এবং তাদের মিত্র ব্ল্যাক নাইট ও ললির কাছ থেকে।
রেজিনাল্ড ট্রুত দ্য ববায়েফ ও তার মিত্রদের কাছে।
তোমরা আমাদের মনিব সেড্রিক, লেডি রোয়েনা, স্যাক্সন বীর অ্যাথেলস্টেন ও তাদের চাকরবাঁকরদের বন্দী করেছে। জনৈক ইহুদী ইয়র্কের আইজাক এবং তার মেয়ে রেবেকাকেও বন্দী করেছে।
আমরা, এক ঘণ্টার ভেতর এই সব কজন বন্দীর মুক্তি দাবি করছি। যদি এক ঘণ্টার ভেতর ওঁদের মুক্তি দেয়া না হয়, আমরা তোমাদের দুর্গ আক্রমণ করে তোমাদের ধ্বংস করে দেবো।
হার্ট হিল ওয়াক-এর বিশাল ওক গাছের নিচে বসে আমরা স্বাক্ষর করছি এই চিঠিতে।
ওয়াম্বা
গার্থ
ব্ল্যাক নাইট
লক্সলি।
পড়া শেষ হতেই হো-হো করে হেসে উঠলো বোয়া-গিলবার্ট। দ্য ব্রেসিও যোগ দিলো তার সঙ্গে। কিন্তু ফ্ৰঁত দ্য বোয়েফের মুখে হাসি ফুটলো না। কেমন যেন সন্ত্রস্ত দেখাচ্ছে তাকে। এক পার্শ্বচরকে ডেকে জিজ্ঞেস করলো, বাইরে কত লোক জড় হয়েছে দেখেছো নাকি?