কয়েক মুহূর্ত রোয়েনাকে কাঁদতে দিলো দ্য ব্রেসি। তারপর কোমলকণ্ঠে বললো, এক্ষুনি অবশ্য তোমার ভাবনার কিছু নেই। তবে সিদ্ধান্ত নিতে খুব বেশি দেরি করে ফেলল না, তাহলে যে কি হবে আমি বলতে পারি না।
এমন সময় বাইরে থেকে ভেসে এলো ট্রাম্পেটের আওয়াজ। দ্রুত পায়ে বেরিয়ে গেল দ্য ব্রেসি।
মেঝের ওপর আছড়ে পড়ে কান্নায় ভেঙে পড়লো রোয়েনা।
.
দুজন লোক দুর্গের মিনারগুলোর একটার একেবারে ওপরের একটা কক্ষে নিয়ে গেল রেবেকাকে। সেখানে বসে চরকায় সূতা কাটছে শীর্ণদেহ এক বৃদ্ধা।
এই, বুড়ি, ভাগো এখান থেকে। চিৎকার করে উঠলো এক লোক। ঘরটা আমাদের লাগবে। এক্ষুনি বেরোও!
এক্ষুনি বেরোববা! আমি! হাহ্, আমার সেই দিনগুলোর কথা মনে পড়ে যাছে, যখন আমিই এখানে আদেশ করতাম, আর তোরা শুনতি।
উলরিকা, ঐ সব মনে করাকরি এখন থামাও, যা বললাম তাড়াতাড়ি করো। খালি করে দাও ঘরটা। তোমার যখন দিন ছিলো আদেশ করছে, এখন আমাদের দিন আমরা করছি।
মর তোরা, কুত্তার দল! একেবারে খ্যাক ম্যাক করে উঠলো বুড়ি। হাতের কাজ শেষ হওয়ার আগে এঘর থেকে আমি কোথাও যাচ্ছি না। যা পারিস তোরা কর।
দেখ, বুড়ি, একটু নরম হয়েছে লোকটার গলা, মনিব একথা জানলে কি…
দূর হ শয়তানের বাচ্চারা! এবার আরো জোরে চিৎকার করলো বুড়ি উলরিকা।
তাকে আর ঘটানোর সাহস পেলো না লোক দুজন। বললো, ঠিক আছে, আমরা যাচ্ছি। এই মেয়েটা থাকলো। খেয়াল রেখো, এখান থেকে যেন না যায় কোথাও। তোমার কাজ শেষ হলে আমরা আবার আসবো।
চলে গেল দুজন।
শয়তানগুলো আবার কোন কুকীর্তি করেছে কে জানে? বিড় বিড় করে বললো বুড়ি। ফুলের মতো মেয়েটাকে কোত্থেকে ধরে আনলো? যেখান থেকেই আনুক, ওর কপালে যে কি আছে তা আমি ভালোই বুঝতে পারছি। চরকা কাটা থামিয়ে রেবেকার দিকে তাকালো উলরিকা। বললো, কালো চুল, কালো চোখ, শাদা চামড়া! বুঝতে পারছি, কেন তোকে এনেছে। তুই বিদেশী, তাই না? কোথায় তোর দেশ? মিসর না প্যালেস্টাইন?
কি বলবে রেবেকা? নিঃশব্দে কাঁদছে ও।
কথা বল, মেয়ে। কাঁদতে পারছিস কথা বলতে পারছিস না?
এখনো চুপ রেবেকা। অসহিষ্ণু হয়ে উঠলো বুড়ি।
আ মলো যা, বোবা নাকি? খনখনে গলায় চিৎকার করলো সে।
বুড়ি মা, রাগ কোরো না, চোখের পানি মুছে বললো রেবেকা।
বাহ্, এই তো কথা বেরিয়েছে!
বলতে পারো, এরা আমাকে ধরে এনেছে কেন?
কেন ধরে এনেছে?–হি-হি-হি, হেসে উঠলো বুড়ি। আমার দিকে তাকা, এককালে আমিও তোর মতো তরুণী, সুন্দরী ছিলাম। আর এখন! এই দুর্গ-প্রাসাদের মালিক ছিলো আমার বাবা, একজন গর্বিত স্যাক্সন। তোকে যে ধরে এনেছে সেই ফ্ৰঁত দ্য বোয়েফের বাবা তাকে হত্যা করে দখল করে নেয় এই দুর্গ। আমার সাত ভাইও মারা যায় ঐ বদমাশের হাতে। আমি একাই কেবল বেঁচে যাই–বলা ভালো আমাকে ওরা বাঁচিয়ে রাখে ওদের দাসত্ব করার জন্যে।
পালানোর কোনো পথ নেই?
এখান থেকে? মৃত্যুর দরজা ছাড়া আর কোনো পথ নেই এখান থেকে পালানোর। নিজেই দেখতে পাবি, হি-হি-হি।
পাগলের মতো হাসতে হাসতে উঠে দাঁড়ালো বুড়ি উলরিকা। তারপর বেরিয়ে গেল তার চরকা, সূতো নিয়ে। দরজা বন্ধ করে তালা লাগিয়ে দিলো বাইরে থেকে।
ভালো করে ঘরটা পরীক্ষা করলো রেবেকা, পালানোর কোনো পথ পাওয়া যায় যদি। কিন্তু না, তেমন কিছু ওর নজরে পড়লো না। আক্রান্ত হলে আত্মরক্ষা করার মতো কোনো কিছুও দেখতে পেলো না। ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করার ব্যবস্থা নেই। একটা মাত্র জানালা ঘরে। খুলে দেখলো রেবেকা। নিচে, অনেক নিচে, দুর্গের শান বাঁধানো চত্বর। খাড়া নেমে গেছে মিনারটা। হ্যাঁ এ জানালা দিয়ে পালানো যায় বটে, তবে পালিয়ে চলে যেতে হবে একেবারে পরপারে। শিউরে উঠলো রেবেকা।
কয়েক মিনিট পরেই বাইরে পায়ের আওয়াজ পাওয়া গেল। দরজা খুলে ঘরে ঢুকলো এক লোক। দীর্ঘদেহী, পরনে ডাকাতের পোশাক। শরীরে যত গহনা ছিলো সব একে একে খুলতে শুরু করলো রেবেকা। দরজা বন্ধ করে ওর দিকে মুখ করে দাঁড়ালো লোকটা। গহনাগুলো এগিয়ে দিয়ে রেবেকা বললো, এগুলো সব নিয়ে ছেড়ে দাও আমাকে আর আমার বুড়ো বাবাকে।
প্যালেস্টাইনের ফুল, নরম্যান ভাষায় জবাব দিলো লোকটা, গহনাগুলো সুন্দর, উজ্জ্বল; কিন্তু তুমি যে আরো বেশি সুন্দর, আরো বেশি উজ্জ্বল। আমি তোমার গহনা নয়, সুন্দরী, তোমাকে চাই।
আপনি তাহলে ডাকাত নন! বিস্মিত কণ্ঠে, চিৎকার করে উঠলো রেবেকা। আপনি নরম্যান নাইট!
ঠিকই ধরেছে। আমি নাইট টেম্পলার ব্রায়ান দ্য বোয়া-গিলবার্ট। আমি তোমার গা থেকে অলঙ্কার কেড়ে নেয়ার চেয়ে তাকে আরো ভালো অলঙ্কার দিয়ে সাজাতে আগ্রহী।
আমাকে সাজিয়ে কি লাভ হবে আপনার? আপনি খ্রীষ্টান, আমি ইহুদী। আপনার, আমার কোনো ধর্ম অনুযায়ী তো আমাদের বিয়ে হতে পারে না।
দেখ, আমি আমার বাহুবলে তোমাকে বন্দী করে এনেছি, এখন আমার ইচ্ছাই হবে তোমার আইন, তোমার ধর্ম, বলতে বলতে রেবেকার দিকে এক পা এগোলো, বোয়া-গিলবার্ট।
ওখানেই দাঁড়ান! চিৎকার করে উঠলো রেবেকা, আর এক পা-ও এগোবেন না!
আচমকা এই চিৎকারে থমকে গেল ব্রায়ান। পর মুহূর্তে আবার এগোতে লাগলো পা পা করে।
চেঁচাও যত চেঁচাবে, বললো সে, কেউ তোমার চিৎকার শুনতে পাবে। পেলেও এগিয়ে আসবে না সাহায্য করতে। এই দুর্গে যারা আছে সবাই আমাদের লোক। তারচেয়ে বলি কি, আমার বউ হও। এমন প্রাচুর্যের ভেতর রাখবো, আমাদের নরম্যান মহিলারা পর্যন্ত হিংসে করবে তোমাকে।