দ্রুত শ্বাসপ্রশ্বাস বইছে নাইটের। এখনো রাগ যায়নি। তবু যাজকের কথায় চাকুটা নামিয়ে নিলো সে। ঘোড়াটাকে কয়েক কদম এগিয়ে নিয়ে ওয়াম্বার সামনে দাঁড়ালেন অ্যায়মার। একটি রৌপ্যমুদ্রা দিলেন ওর হাতে। বললেন, তুমি নিশ্চয়ই বলতে পারবে সেড্রিকের বাড়ি কোন দিকে?
চুপ করে আছে ওয়াম্বা।
ক্লান্ত পথচারীদের সাহায্য করা খ্রীষ্টান হিশেবে তোমার কর্তব্য, তাই? আবার বললেন ধর্মযাজক।
নিশ্চয়ই। কর্তব্য মানে?-এক নম্বর কর্তব্য! কিন্তু, ফাদার, আসল কথাটা কি, বলবো? আপনার সঙ্গীর মেজাজ দেখে আমার মাথা ঘুরছে। আমি নিজেই আজ পথ চিনে আমার প্রভুর বাড়ি পৌঁছুতে পারবো কিনা সন্দেহ, তো আপনাকে কি জানাবো?
কি আবোল-তাবোল বকছো? ইচ্ছে করলেই তুমি পথটা দেখিয়ে দিতে পারো।
বেশ, তাহলে এই পথ ধরেই চলে যান। যতক্ষণ না একটা পাথরের ক্রুশ দেখতে পাবেন ততক্ষণ নাক বরাবর এগিয়ে যাবেন। দেখবেন কুশটার কাছে চারটে পথ এসে মিশেছে চারদিক থেকে। সোজা যাবেন না, ডানে যাবেন না, পেছনে তো ফিরবেনই না। তাহলে কাকি থাকলো কি? বাঁ দিক। হাঁ, বাঁ দিকের পথ ধরে এগোবেন, আমার মনে হয় ঝড় ভালো মতো আসার আগেই আপনারা আশ্রয়ে পৌঁছে যাবেন।
অনেক অনেক ধন্যবাদ। ঈশ্বর তোমার মঙ্গল করুন, বলে সঙ্গীর দিকে তাকালেন অ্যায়মার। চলুন তাহলে, স্যার ব্রায়ান। আর দেরি করলে ভিজতে হবে।
হ্যাঁ চলুন।
অনুচরদের নিয়ে ওয়াম্বার দেখানো পথে ঘোড়া ছোটালেন প্রায়োর ও নাইট টেম্পলার।
ওঁদের ঘোড়ার আওয়াজ-মিলিয়ে যেতেই একে অন্যের দিকে তাকিয়ে প্রাণ খুলে হাসলো গার্থ আর ওয়াম্বা। গার্থ বললো, তোমার পরামর্শ মতো গেলে আজ সারা রাতেও রদারউডে পৌঁছুতে পারবে না ওরা।
তা না পারুক, শেফিল্ডে তো পৌঁছুবে। আমার মনে হয় সেটাই ভালো হবে ওদের জন্যে।
হ্যাঁ, ভালোই করেছো ভুল পথে পাঠিয়ে। ওরা নরম্যান। দুজনই। বাড়িতে আশ্রয় চাইলে আমার মনে হয় কিছুতেই রাজি হতেন না মনিব। ঐ চোয়াড়ে নাইটটার মেজাজ তো দেখলেই, কি হতো তারপর?
নির্ঘাত হাতাহাতি বেধে যেঙ্গে, বললে ওয়াম্বা। যদি কোনো রকমে একবার লেডি রোয়েনাকে দেখতে ঐ বদমাশটা, আমি ভাবতেও পারছি না কি ঘটতো।
হ্যাঁ, মনিবের ঝামেলা আরেকটু বাড়তো আর কি। চলো এগোই।
.
বেয়াদবগুলোকে একটু শিক্ষা দিতে চাইলাম, আপনি বাধা দিলেন কেন? কিছুদূর আসার পর জিজ্ঞেস করলো নাইট টেম্পলার স্যার ব্রায়ান দ্য বোয়াগিলবার্ট।
শিক্ষা দিতে চাইছিলেন না ঝগড়া বাধাতে চাইছিলেন? জবাব দিলেন যাজক। ওদের কথাগুলো খেয়াল করেননি? সেড্রিক ওদের মনিব, ওদের গায়ে হাত তুললে সেড্রিক আপনাকে ছেড়ে কথা কইতো না। এই লোকটার সম্পর্কে ভাললা মতো জেনে রাখা দরকার আপনার।
বলুন শুনি, বললো বটে কিন্তু খুব একটা গুরুত্ব দিয়ে যে তা মনে হলো না ব্রায়ানের কণ্ঠস্বর শুনে।
অত্যন্ত ধনী জমিদার এই সেড্রিক। এর মতো ধনশালী স্যাক্সন এ অঞ্চলে আর আছে বলে আমার জানা নেই। যেমন ধনী তেমনি দাম্ভিক ব্যাটা। লোকে তাকে স্যাক্সন সেড্রিক বললে সে গর্ব অনুভব করে। আমাদের, নরম্যানদের ও মনে প্রাণে ঘৃণা করে। প্রতিবেশী রেজিনাল্ড ট্রুত দ্য ববায়েফ বা ফিলিপ ম্যালভয়সিঁর মতো দুর্ধর্ষ, প্রতাপশালী নরম্যান জমিদারদের সাথে পর্যন্ত বিরোধ বাধাতে সে ভয় পায় না। ভীষণ বদমেজাজী–অনেকটা আপনার মতোই। সুতরাং সাবধান থাকবেন ওর সাথে কথা বলার সময়।
তা থাকবে। আপনি সেড্রিক সম্পর্কে যা বললেন তাতে মনে হচ্ছে ব্যাটার মন পেতে অনেক কিছু সইতে হবে আমাকে। ঠিক আছে, দরকার হলে সইবো। যার সৌন্দর্যের খ্যাতি দূর দূরান্তে ছড়িয়ে পড়েছে সেই লেডি রোয়েনাকে দেখবার জন্যে এটুকু কষ্ট না হয় আমি স্বীকার করলাম। কিন্তু, ফাদার, একটা কথা বলুন তো, মেয়েও কি বাপের মতোই নরম্যানদের ঘৃণা করে?
সেড্রিক ওর বাবা নয়, বললেন প্রায়োর। অভিভাবক। সম্পর্কের আত্মীয়। তাহলেও রোয়েনাকে ও নিজের মেয়ের মতোই ভালোবাসে।
আচ্ছা!
হ্যাঁ। আর রোয়েনার সৌন্দর্য সম্পর্কে তো আগেই আপনাকে বলেছি, এ তল্লাটে অমন সুন্দরী আর একটাও আছে কি না সন্দেহ।
আমরা একটা বাজি ধরেছিলাম, মনে আছে তো আপনার?
নিশ্চয়ই আছে। আমি যেমন বলেছি রোয়েনা যদি তেমন সুন্দরী না হয়, আমার কলারের এই সোনার কাঁটা আপনি পাবেন; আর আমার কথা যদি ঠিক হয় আপনি আমাকে দেবেন দশ পিপে ভালো ফরাসি মদ।
হ্যাঁ। তবে কথা হলো কি, রোয়েনার রূপ কেমন বিচার করবো। তো আমিই, সুতরাং ধরে নিতে পারেন, সোনার কাঁটাটা আপনি হারাচ্ছেন।
সে যখন হারাবো তখন দেখবো। এবার দয়া করে আপনি একটু চুপ করুন দেখি। এখন থেকেই মুখ বুজে থাকা অভ্যাস না করলে সেড্রিকের সামনে কি না কি বলে বসবেন, শেষে এই ঝড় বাদলের ভেতর পথে রাত কাটাতে হবে।
তা ঠিক, তা ঠিক। বেশ, আমি তাহলে এখন থেকে চুপ করেই থাকবে। তার আগে আরেকটা প্রশ্ন, সেড্রিকের নিজের কোনো ছেলে মেয়ে নেই?
আছে। একটাই মাত্র ছেলে, উইলফ্রিড অভ আইভানহো। ছেলেটাকে ও বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে।
নিজের একমাত্র ছেলেকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে।
বললাম কি তাহলে? ভীষণ বদমেজাজী লোক এই সেড্রিক। ওর মতের বিরুদ্ধে কেউ কিছু বললে, সে যে-ই হোক, তার আর রক্ষা নেই। শোনা যায় আইভানহো রোয়েনাকে বিয়ে করতে চেয়েছিলো বলেই ওকে বাড়িছাড়া করেছে সেড্রিক।