আরে, ইহুদী কুত্তা, তুমি কি পাগল হয়ে গেলে? আগুনের কথা মনে নেই?
আগুন কেন, ইচ্ছে হলে আরো খারাপ কিছু আনতে পারো, কিন্তু আমি যা বলেছি তাতে কোনো নড়চড় হবে না।
ধরো ওকে! চিৎকার করে উঠলো ফ্ৰঁত দ্য বোয়েফ।
এবারও এক মুহূর্ত দেরি না করে নির্দেশ পালন করতে লেগে গেল ভৃত্যরা। বৃদ্ধের আলখাল্লাটা খোলার চেষ্টা করছে। এই সময় বাইরে থেকে ভেসে এলো ট্রাম্পেটের তীক্ষ্ণ আওয়াজ। তারপর চিৎকার। উদ্বিগ্ন কণ্ঠে কে যেন উপরে ডাকছে ফ্ৰঁত দ্য বোয়েফকে।
বিরক্তির ছাপ পড়লো রেজিনান্ডের চেহারায়।
এখনকার মতো বেঁচে গেলে, ইহুদীর বাচ্চা, চিবিয়ে চিবিয়ে বললো সে। পরের বার আর বাঁচবে না। কথাটা মনে রেখো।
বেরিয়ে গেল সে কুঠরি থেকে। ভূত্যরা অনুসরণ করল তাকে।
হাঁটু মুড়ে বসে ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানালেন বৃদ্ধ। তারপর তার সেই কোনায় গিয়ে কাঁদতে লাগলেন মেয়ের কথা মনে করে।
.
যে মুহূর্তে আইজাকের কুঠরিতে ঢুকেছে ফ্ৰঁত দ্য বোয়েফ ঠিক সেই মুহূর্তে রোয়েনার কক্ষে ঢুকলো দ্য ব্রেসি। ওর পরনে এখন ডাকাতদের নয়, সর্বশেষ ছাঁট কাটের দামী অভিজাত পোশাক। হাঁটু পর্যন্ত মাথা নুইয়ে রোয়েনাকে অভিবাদন জানালো সে।
আমাকে এখানে ধরে এনেছেন কেন? কেন আমাকে বন্দী করা হয়েছে?
সুন্দরী, বিগলিত হেসে দ্য ব্রেসি বললো, কে বলেছে তুমি বন্দী?–বন্দী তো আমি। তোমার রূপের শিকল আমাকে যে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলেছে, রোয়েনা।
দেখুন, আপনাকে আমি চিনি না, শীতল কণ্ঠে বললো রোয়েনা। আবার আপনাকে জিজ্ঞেস করছি, কেন আমাকে ধরে এনেছেন?
তুমি আমার স্বপ্নের রানী, হৃদয়ের রানী শুরু করলো দ্য ব্রেসি, কিন্তু তাকে থামিয়ে দিলো রোয়েনা।
দয়া করে প্রলাপ বন্ধ করুন, বললো সে। আমার প্রশ্নের জবাব দিন। কেন আমাকে ধরে আনা হয়েছে?
দ্য ব্রেসির অমায়িক মুখখাশটা এবার খসে পড়ে গেল।
শাদা কথায় জানতে চাও, তাই তো? রুক্ষ হয়ে উঠেছে তার গলা। তাহলে শোনো, শাদা কথায়ই বলছি, আমাকে যদি বিয়ে না করো এই প্রাসাদ-দুর্গ থেকে তুমি বেরোতে পারবে না। নিজেকে সামলে নিয়ে আবার অমায়িক মুখোশটা পরে নিলো দ্য ব্রেসি। প্রিয়তমা, যা করেছি তোমার মঙ্গলের জন্যেই করেছি। যে জঘন্য স্যাক্সন পরিবেশে তুমি মানুষ হয়েছে তা থেকে মুক্তি দিতে চাই। দেশের অভিজাত মহলে প্রতিষ্ঠা পেতে হলে, সারা ইংল্যান্ডে তোমার সৌন্দর্যের খ্যাতি ছড়িয়ে দিতে হলে আমার মতো সভ্রান্ত মানুষকে বিয়ে করা ছাড়া তোমার আর পথ কোথায়?
কে চায় অভিজাত মহলে প্রতিষ্ঠা পেতে, বিশেষ করে আপনার মতো বদমাশরা যে মহলের বাসিন্দা? আর যে জঘন্য পরিবেশের কথা বলছেন ছেলেবেলা থেকে সেখানেই আমি মানুষ হয়েছি। তা যদি কোনো দিন ছেড়ে যেতে হয়, যাব এমন লোকের সাথে যে ঐ পরিবেশের নামে আপনার মতো নাক সিঁটকাবে না।
তোমার মনের গোপন ইচ্ছাটা যে জানি না তা নয়, আবার জ্বর হয়ে উঠেছে দ্য ব্রেসির দৃষ্টি। তাহলে শুনে রাখো আমার নাম মরিস দ্য ব্রেসি, আমি যা চাই সব সময় তা পেয়ে থাকি। আপোষে না পেলে শক্তি প্রয়োগেও দ্বিধা করি না। যদি ভেবে থাকো স্বপ্নের কোনো বীর এসে তোমাকে উদ্ধার করবে তাহলে ভুল ভেবেছো। রিচার্ড আর কোনোদিনই ইংল্যান্ডের সিংহাসনে বসবে না; তার প্রিয় পাত্র আইভানহোও কোনোদিন তোমার হাত ধরে তার সামনে যাওয়ার সুযোগ পাবে না। আইভানহো এখন আমাদের হাতে বন্দী। এই দুর্গেই আছে।
আইভানহো! এখানে! সবিস্ময়ে চিৎকার করে উঠলো রোয়েনা।
হ্যাঁ, সুন্দরী। ইহুদী আইজাকের মেয়ে রেবেকার পাল্কি-গাড়িতে ও ছিলো। তোমাদের সাথেই এসেছে অথচ তুমি কিছু জানো না, আশ্চর্য ব্যাপার! তাহলে শোনো, আরেকটা খবর তোমাকে দেই, ফ্ৰঁত দ্য বোয়েফ এখন আইভানহোর প্রতিদ্বন্দ্বী।
আইভানহোর প্রতিদ্বন্দ্বী ফ্ৰঁত দ্য বোয়েফ! কেন?
তুমি ভান করছে, নাকি আর দশজন মেয়ের মতো ছলনার জাল বিস্তার করতে চাইছে আমি বুঝতে পারছি না, রোয়েনা। একজন অসুস্থ মানুষের সঙ্গে সুস্থ মানুষের প্রতিদ্বন্দ্বিতা কখন হতে পারে বোঝো না? ঈর্ষা। হ্যাঁ, রোয়েনা, ঈর্ষা। রেজিনান্ড চায় রেবেকাকে, অথচ রেবেকা হৃদয় দিয়ে বসে আছে তোমার আইভানহোকে। এখন রেবেকাকে পেতে হলে কি করবে রেজিনাল্ড? আইভানহোকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দিলেই সব দিক থেকে সুবিধা তার। মনের মানুষই যদি পৃথিবীতে না থাকে তাহলে মন দেবে কাকে রেবেকা? তাছাড়া আইভানহোর যে সব সম্পত্তি রেজিনান্ড ভোগ করছে সেগুলোর ব্যাপারেও একশো ভাগ নিশ্চিত হয়ে যেতে পারবে সে। আইভানহো না থাকলে কে আর দাবি করবে আইভানহোর সম্পত্তি? বুঝতেই পারছো, আইভানহোর সামনে এখন মহাবিপদ। কিছু না, ডাক্তারকে ওর ওষুধের সাথে এক ফোটা বিষ মিশিয়ে দিতে বললেই হবে।
ঈশ্বরের দোহাই, আপনি বাঁচান আইভানহোকে!
হ্যাঁ বাঁচাতে পারি, মুচকি হাসলো দ্য ব্রেসি, যদি তুমি আমার কথায় রাজি হও। আমার স্ত্রীর আত্মীয় স্বজন বা ছেলেবেলার খেলার সাথীর গায়ে হাত দেয়ার সাহস কারো হবে না। কিন্তু ঐ যে বললাম, তার আগে তোমাকে আমার স্ত্রী হতে হবে। নইলে কেন আমি কোথাকার কোন আইভানহোর জন্যে ঘনিষ্ঠ বন্ধুর সাথে বিবাদ করতে যাবো?
এতক্ষণ কোনো রকমে আত্মসংবরণ করে ছিলো রোয়েনা, এবার আর পারলো না। একেবারে ভেঙে পড়লো। তার দুচোখ ছাপিয়ে জল নেমে এলো মুখে ঘনিয়ে উঠলো হতাশা আর বিষাদের কালো ছায়া।