যাজকের সহযাত্রী একজন নাইট। সাধারণ নয়, টেম্প-এর খেতাব পাওয়া নাইট* বয়েস চল্লিশের কোঠায়। দীর্ঘদেহী, ছিপছিপে গড়ন, পেশল শরীর, গায়ের চামড়া রোদে পুড়ে তামাটে বর্ণ নিয়েছে। চেহারায় বেপরোয়া ভাব। অহষ্কারের সাথে হিংস্রতা আর নিষ্ঠুরতা মিশলেই কেবল এমন ছাপ পড়তে পারে মানুষের চেহারায়। এক নজর দেখলেই বোঝা যায় লোকটা যোদ্ধা, জীবনে অনেক প্রতিকূলতা সয়েছে, এবং আরো সইবে। লাল একটা আলখাল্লা পরনে। ডান কাঁধে একটা শাদা ক্রস, তার খেতাবের চিহ্ন। আলখাল্লার নিচে পরে আছে লোহার জালের জামা। নিম্নাঙ্গেও লোহার পোশাক। হাতে লোহার জালের দস্তানা। মাথায় ধাতব শিরোম্রাণ। কোমরে দীর্ঘ তরবারি, খাপে মোড়া। ধর্মযাজকের মতোই দারুণ একটা ঘোড়ায় চেপে আসছে সে। পেছনে তার যুদ্ধের ঘোড়া, যুদ্ধের সাজ পরা, এক ভৃত্য লাগাম ধরে টেনে আনছে। আরেক ভূত্য বয়ে আনছে তার ঢাল ও বর্শা। বর্শার মাথায় একটা পতাকা বাঁধা, কুশ আঁকা তাতে। ঢালটা তিন কোনাচে, হলদে রঙের কাপড়ে মোড়া। এই দুই ভৃত্যের পেছনে আরো দুজন ভৃত্য। দীর্ঘদেহী দুজনই। গায়ের রঙ কালো। রেশমী ঢোলা পোশাক তাদের গায়ে। মাথায় টুপি। এক পলক দেখেই বলে দেয়া যায় তারা প্যালেস্টাইনী আরব।
স্থির দাঁড়িয়ে আছে গার্থ এবং ওয়া। বিস্মিত চোখে দেখছে ছোট্ট মিছিলটাকে। ইতোমধ্যে ওয়ার মতো গাৰ্থও কৌতূহলী হয়ে উঠেছে। ধর্মযাজককে দেখার সঙ্গে সঙ্গেই চিনতে পেরেছে সে। জরভক্স মঠের প্রায়োর (প্রধান পুরোহিত) তিনি। নাম অ্যায়মার। ধর্মযাজক হওয়া সত্ত্বেও শিকার খুব প্রিয় তার, খাওয়া দাওয়ার ব্যাপারেও খুব উৎসাহী তিনি, এ ছাড়াও স্বভাবের আরেকটি বিশেষ দিক হলো, কোনো ধরনের জাগতিক ভোগবিলাসেই তার অরুচি নেই। এ তল্লাটের আর দশজন মানুষের মতো গার্থও জানে এসব কথা। তাই অনিচ্ছাসত্ত্বেও প্রায়োর অ্যায়মারকেঅভিবাদন জানিয়ে নাইট টেম্পলারের দিকে তাকালো সে।
লোকটাকে এ অঞ্চলে কখনো দেখেছে বলে মনে হলো না ওর।
গার্থের অভিবাদনের জবাবে প্রায়োর বললেন, তোমাদের মঙ্গল হোক। জিজ্ঞেস করলেন, আচ্ছা, বলতে পারো, এদিকে রাতের মতো আশ্রয় পাওয়া যেতে পারে কোথায়?
গাৰ্থ এবং ওয়াম্বাও তখন হাঁ করে তাকিয়ে আছে ধর্মযাজকের সঙ্গী ও তার প্রাচ্যদেশীয় অনুচরদের দিকে। অ্যায়মারের প্রশ্ন তারা শুনতেই পেলো না।
যাজক আবার প্রশ্ন করলেন, একটা কথা জানতে চেয়েছিলাম তোমাদের কাছে।
এবার সংবিত ফিরলো গার্থের। বললো, জি, বলুন।
এদিকে রাতের মতো আশ্রয় পাওয়া যেতে পারে এমন কোনো জায়গা আছে?
না, কাছাকাছি তেমন কোনো জায়গা আছে বলে আমার জানা নেই, জবাব দিলো ওয়া। তবে একটু কষ্ট করে আরো কয়েক মাইল যদি এগিয়ে যান, ব্রিক্সওয়ার্ধের মঠ পাবেন। ওখানকার প্রায়োর নিশ্চয়ই আপনাদের আশ্রয় দেবেন। মনে হয় ভালো খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থাও করতে পারবেন উনি। রাতটা আরামেই কাটবে আপনাদের।
না, না, ব্রিক্সওয়ার্থ মঠ অনেক দূর, বললেন অ্যায়মার, এই ঝড় বৃষ্টির ভেতর অতদূর যাওয়া যাবে না। আরো কাছে কোনো জায়গা নেই?
যা আছে, তবে খুব কাছে না; আর ওখানে গেলে রাতের বেলায় ঘুমের আশা ছাড়তে হবে আপনাদের। উপাসনা করে কাটাতে হবে সারারাত। এই যে এই পথ ধরে এগিয়ে গেলে পাবেন সন্ন্যাসী কপম্যান হারে আশ্রম। উনিও নিশ্চয়ই আপনাদের পেয়ে খুশি হবেন।
এ প্রস্তাবটাও মনঃপূত হলো না যাজকের। বিরক্তির সঙ্গে মাথা নাড়লেন তিনি।
তাঁর সঙ্গী নাইট টেম্পলার এবার কথা বললেন।
আমার ধারণা, স্যাক্সন সেড্রিকের বাড়ির কাছাকাছি এসে গেছি আমরা। সেখানেই চলুন না, প্রায়োর।
হ্যাঁ, হ্যাঁ, ঠিক বলেছেন, জবাব দিলেন অ্যায়মার। গাৰ্থ ও ওয়ার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন, রদারউডের সেড্রিকের বাড়িটা কোথায় বলতে পারো তোমরা?
অ্যাঁ, হ্যাঁ, তা বোধহয় পিরবো, জবাব দিলো গাৰ্থ। তার কণ্ঠস্বরে সাহায্য করার ইচ্ছার চেয়ে অনিচ্ছাই প্রকাশ পেলো বেশি। তবে আপনারা সেখানে পৌঁছাতে পারবেন কিনা জানি না, পথটা খুব ঘোরপ্যাচের। তাছাড়া, যদি শেষ পর্যন্ত বাড়িতে পৌঁছানও, গিয়ে হয়তো দেখবেন বাড়ির সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে।
আমরা এসেছি শুনলে ওরা খুশি হয়ে বিছানা ছেড়ে উঠে আসবে, গর্বিত শোনালো নাইট টেম্পলারের কণ্ঠস্বর।
তাই কি! তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে বললো গাৰ্থ। ওর প্রভুর মতো ও-ও নরমানদের মনে প্রাণে ঘৃণা করে! নাইটের কথা ওর কাছে রীতিমত ঔদ্ধত্যপূর্ণ মনে হয়েছে। এক মুহূর্ত বিরতি নিয়ে সে যোগ করলো, তার মানে আপনি বলতে চাইছেন আমার মনিব আপনাদেরকে আশ্রয় দিয়ে কৃতার্থ হবেন? না, জনাব নাইট, আপনাদের কোনো সাহায্য আমি করতে পারছি না।
মুহূর্তে চোখ দুটো অগ্নিশিখার মতো জ্বলে উঠলো নাইট টেম্পলারের।
ব্যাটা স্যাক্সন শুয়োরপালক, তোর এত বড় স্পর্ধা! চিৎকার করে উঠে চাবুক তুললো সে।
পলক ফেলার আগেই গ্লার্থের হাত পৌঁছে গেছে ছুরির বাঁটে। তৈরি সে। নাইট চাবুক দিয়ে আঘাত করার চেষ্টা করলেই ছুরি চালাবে। তাড়াতাড়ি ঘোড়া নিয়ে দুজনের মাঝখানে এসে দাঁড়ালেন প্রায়োর অ্যায়মার।
না, না, কোনোরকম মারামারি চলবে না! বললেন তিনি। স্যার ব্রায়ান, আমরা এখন প্যালেস্টাইনে নেই, কথাটা মনে রাখবেন। ওখানে বিধর্মীদের সাথে যখন যা ইচ্ছা করেছেন, ভালো কথা, তাই বলে এখানেও যদি তেমন করতে চান তাহলে মুশকিল আছে।