কে এই অহঙ্কারী নাইট?
মাথা নাড়লো পার্শ্বচর। কাছাকাছি যারা বসেছিলেন সবার দিকে একে একে তাকালেন রাজপুত্র। কিন্তু না, নাইটকে চেনে এমন কোনো আভাস দেখতে পেলেন না কারো চেহারায়। হঠাৎ ফিসফিস করে কে একজন বলে উঠলো:
সিংহ-হৃদয় রিচার্ড নন তো?
কথাটা কানে গেল রাজপুত্রের। শরীরের রক্ত তার হিম হয়ে আসতে চাইলো।
ওহ, ঈশ্বর! আর্তনাদ করে উঠলেন তিনি। ওয়াল্ডেমার, দ্য ব্রেসি, আপনাদের প্রতিশ্রুতির কথা মনে আছে তো? আমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করবেন না!
দুশ্চিন্তা করবেন না, রাজপুত্র, ওয়ান্ডেমার বললেন। এই নাইট আর যে-ই হোক, আপনার ভাই নন। রিচার্ড আকার আয়তনে কমপক্ষে এর দ্বিগুণ হবেন।
শুনলেন বটে, কিন্তু স্বস্তি পেলেন না জন। বিজয়ীর হাতে যখন পুরস্কারের ঘোড়া তুলে দিচ্ছেন তখনও–দুরু দুরু করছে তার বুকের ভেতরটা। প্রতি মুহূর্তে আশঙ্কা করছেন, এই বুঝি শোনা গেল রিচার্ডের গভীর গম্ভীর ক্রুদ্ধ কণ্ঠস্বর। সৌভাগ্য তার, তেমন কিছু ঘটলো না। উত্তরাধিকার বঞ্চিত নাইট মাথা নুইয়ে অভিবাদন জানালো কেবল। সদ্য পাওয়া ঘোড়াটায় চড়ে বসলো সে। বর্শা সোজা করে ধরে মাঠের চারপাশে চক্কর দিতে লাগলো ধীর কদমে। দর্শকরা তালি বাজিয়ে, চেঁচিয়ে অভিনন্দিত করতে লাগলো তাকে।
মাঠ প্রদক্ষিণ শেষে আবার রাজপুত্রের সামনে এসে দাঁড়ালো নাইট। জন হাত তুলে আরেকটু সামনে এগোনোর নির্দেশ দিলেন তাকে। বললেন, স্যার নাইট, এবার তোমার কর্তব্য হবে আগামীকালের টুর্নামেন্টের জন্যে সৌন্দর্য ও প্রেমের রানী নির্বাচন করা। তোমার বর্শাটা একটু এগিয়ে দাও।
নিঃশব্দে নির্দেশ পালন করলো নাইট। বর্শার ফলার ওপর সবুজ রেশম আর সোনার তৈরি একটা মুকুট বসিয়ে দিলেন রাজপুত্র।
তরুণ নাইট ধীর গতিতে ঘোড়া চালিয়ে এগিয়ে গেল মহিলাদের গ্যালারির দিকে। অপূর্ব একটা মুখ খুঁজছে তার দুচোখ। সে মুখ রোয়েনার। কিন্তু কোথায় রোয়েনা? অন্য মহিলাদের ওপর নাইটের দৃষ্টি পড়তেই অনেকের গাল লাল হয়ে উঠলো, অনেকে গর্বিত ভঙ্গিতে মুখ ঘুরিয়ে নিলো, অনেকে সলজ্জ হেসে নামিয়ে নিলো চোখ।
অবশেষে লেডি রোয়েনাকে দেখতে পেলো সে। সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। নাইট। আস্তে আস্তে বর্শার মাথাটা নামিয়ে এনে মুকুটটা রাখলো রোয়েনার পায়ের কাছে।
বাজনা বেজে উঠলো। ট্রাম্পেটের আওয়াজ ছিঁড়ে ফেলতে চাইলো আকাশ। কয়েক মুহূর্ত মাত্র। তারপরই আবার সব চুপ। দুএকজন দর্শকের বিচ্ছিন্ন চিৎকার শোনা যাচ্ছে কেবল। ঘোষক এগিয়ে এসে সৌন্দর্য ও প্রেমের রানী হিশেবে ঘোষণা করলো রোয়েনাকে।
একজন স্যাক্সন তরুণীকে সৌন্দর্য ও প্রেমের রানী নির্বাচিত করায় ক্ষেপে গেলেন অনেক নরম্যান মহিলা। আর সাধারণ দর্শকরা স্রেফ বুনো হয়ে উঠলো খুশিতে।
রাজপুত্র জন আসন ছেড়ে এগিয়ে এলেন রোয়েনার কাছে।
এবার আপনি আপনার সম্মানিত আসন গ্রহণ করুন, বললেন তিনি।
ধন্যবাদ, রাজপুত্র, রোয়েনার হয়ে জবাব দিলেন সেড্রিক। কিন্তু আজ নয়, কাল রোয়েনা নিজেই তার আসনে গিয়ে বসবে।
সেড্রিকের কথায় ভয়ানক অপমানিত বোধ করলেন জন। চোখ মুখ লাল হয়ে উঠলো। তবু তিনি কিছু বললেন না। বলা ভালো, বলার সাহস পেলেন না। উপস্থিত হাজার হাজার দর্শকের বেশির ভাগই স্যাক্সন। স্যাক্সনদের জাদরেল নেতা সেড্রিককে কিছু বললে ওরা চুপ করে থাকবে বলে মনে হয় না। শৃঙ্খলা রক্ষার জন্যে যে কজন রক্ষী আছে, জনতা ক্ষেপে উঠলে পাড়িয়েই মেরে ফেলবে তাদের।
নিঃশব্দে অপমানটা হজম করলেন জন। নিজের জায়গায় ফিরে গিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে ঘোষণা করলেন, প্রথম দিনের টুর্নামেন্ট শেষ হলো।
০৬. নিজের তাঁবুতে ফিরে বিজয়ী নাইট
নিজের তাঁবুতে ফিরে বিজয়ী নাইট দেখলে অনেকেই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে তার জন্যে। সবাই বর্ম খোলায় তাকে সাহায্য করতে চাইলো। সে আজ ওদের সম্মান বাঁচিয়েছে। তাছাড়া সে আসলে কে তা জানার আগ্রহও তাদের কম নয়।
কিন্তু সবাইকেই সবিনয়ে ফিরিয়ে দিলো নাইট। বললো, আপনারা কেন খামোকা কষ্ট করবেন? আমার ভূত্যই যথেষ্ট আমাকে সাহায্য করে জন্যে।
হতাশ মনে সবাই চলে গেল তবু ছেড়ে। তরুণ নাইটের ভূত এগিয়ে এলো তাবুর প্রবেশমুখটা বন্ধ করে দিলো। মনিবের গা থেকে একে একে খুলে নিতে লাগলো যুদ্ধের পোশাকু।
বোকা বোকা চেহারা ভূত্যের। মাথায় এক ধরনের নরম্যান টুপি, যাতে তার মুখের বেশিরভাগই ঢাকা পড়ে গেছে। প্রভুর মতো সে-ও বোধহয় সবার অচেনাই থাকতে চায়।
বর্ম শিরোস্ত্রাণ ছেড়ে হালকা পোশাক পরে নিলো নাইট। তারপর খেতে বসলো। খাওয়া সবেমাত্র শেষ হয়েছে, ভৃত্য এসে জানালো, পাঁচজন লোক তার সাথে দেখা করতে চায়। তাদের সবাই একটা করে যুদ্ধের ঘোড়া নিয়ে এসেছে সাথে করে।
তাড়াতাড়ি মুখের ওপর হুড টেনে দিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলো নাইট।
লোক পাঁচজন আর কেউ নয়, পরাজিত পাঁচ চ্যালেঞ্জারের পার্শ্বচর। পরাজিত নাইটদের ঘোড়া ও অস্ত্রশস্ত্র বিজয়ীর হাতে তুলে দিতে এসেছে। বিজয়ী নাইট হয় ওগুলো রেখে দেবে নয়তো ওগুলোর বদলে উপযুক্ত মূল্য গ্রহণ করবে।
আমার নাম বদোয়া, প্রথমজন বললো, স্যার ব্রায়ান দ্য বোয়াগিলবার্টের পার্শ্বচর আমি। আমার প্রভু আজকের টুর্নামেন্টে যে ঘোড়া ও অস্ত্রশস্ত্র ব্যবহার করেছেন সেগুলো তুলে দিতে এসেছি আপনার হাতে। টুর্নামেন্টের নিয়ম অনুযায়ী হয় আপনি ওগুলো গ্রহণ করবেন, না হয় আমার প্রভুকে আবার ওগুলো আপনার কাছ থেকে কিনে নেয়ার সুযোগ দেবেন।