জমিদার সেড্রিকের মাইনে করা ভাঁড় সে। মনিবকে হাসানোর জন্যে উদ্ভট কথাবার্তা বলা, অঙ্গভঙ্গি করাই তার কাজ।
একে সন্ধ্যা হয়ে আসছে, তার ওপর মেঘ জমছে আকাশে। ব্যস্ত হয়ে উঠলো গার্ক। পালের শুয়োরগুলোকে এক জায়গায় জড়ো করার জন্যে শিঙা ফুকতে লাগলো। কিন্তু লাভ হলো না। বার কয়েক মাথা নেড়ে, ঘোঁত ঘোঁত শব্দ করে যেমন চরছিলো তেমনি চরে বেড়াতে লাগলো শুয়োরগুলো। ঘাসের ভেতর থেকে খুঁটে খুঁটে খাচ্ছে ওক ফল।
আরো কয়েকবার শিঙা বাজালো গাৰ্থ। শেষে বিরক্ত হয়ে বলে উঠলো, জাহান্নামে যা, শুয়োরের বাচ্চারা! সঙ্গের কুকুরটাকে লেলিয়ে দিলো শুয়োরগুলোর ওপর। চিৎকার করলো, ধর, ধর, ফ্যাংস!
লাফিয়ে উঠেই ঘেউ ঘেউ করতে করতে ছুটলো ফ্যাংস। কিন্তু সে বেচারার এক ঠ্যাং ঘোড়া, বয়েসও হয়েছে বেশ। যৌবনের ক্ষিপ্রতা আর নেই। শরীরে, গলায় জোরও কমে এসেছে। শুয়োরগুলো পাত্তাই দিলো না ওকে, যেন খাচ্ছিলো খেয়ে যেতে লাগলো।
অবশেষে সঙ্গীর শরণাপন্ন হলে গার্থ।
ওঠো তো, ওয়াম্বা, আমাকে একটু সাহায্য করো, বলা সে। এতগুলো শুয়োর একা এক জায়গায় জড় করা চাট্টিখানি কথা? তুমি যাও, পেছন দিক দিয়ে গিয়ে তাড়িয়ে আনো আমার দিকে।
ওঠবার কোনো লক্ষণ দেখা গেল না ওয়াম্বার ভেতর। জবাবও দিলো না। যেমন ছিলো তেমনি চিন্তিত মুখে তাকিয়ে রইলো বিরাট বিরাট ওক গাছগুলোর দিকে।
কি ব্যাপার, কালা হয়ে গেলে নাকি? কথাগুলো বললাম কানে ঢুকলো না?
ঢুকেছে, গাৰ্থ, ধীরে ধীরে অলসকণ্ঠে জবাব দিলো ওয়া। প্রথমবারেই ঢুকেছে। এবং সেই থেকে আমি আমার পা দুটোর সাথে আলাপ করছি ব্যাপারটা নিয়ে। কিন্তু ওরা স্রেফ নড়তে চাইছে না।
মানে!
মানে ওরা বলছে, এখন যদি শুয়োরের পালের পেছনে ছোটাছুটি করি, আমার কাপড়-চোপড়ের বারোটা বেজে যাবে। তার চেয়ে, ওদের পরামর্শ হচ্ছে, শুয়োরগুলো যেমন চরছে চরুক, তুমি ফ্যাংকে ডেকে নাও।
তোমার কি মাথা খারাপ হলো, ওয়াম্বা! দেখছো সন্ধ্যা হয়ে আসছে, আকাশে মেঘ জমছে, যে কোনো সময় ঝড়-বাদল শুরু হবে, আর তুমি বলছে, যেমন চরছে চরুক, বলতে বলতে গাৰ্থ একাই এগিয়ে গেল শুয়োরগুলোকে জড়ো করার জন্যে।
ওয়াম্বা জবাব দিলো, ভুল বললাম কোথায়? দুচার দিনের ভেতরই তো ওরা নরম্যান হয়ে যাবে, সুতরাং চরছে চরুক না।
যত্ত সব গাঁজাখুরি কথা! শুয়োরের পাল আবার নরম্যান হয় কি করে? আমার সাথে ইয়ার্কি মারছো?
শোনো তাহলে, আমি বুঝিয়ে দিচ্ছি। তার আগে বলল, তুমি কাদের চরাতে নিয়ে এসেছো?।
কাদের আবার, দেখতে পাচ্ছে না?
পাচ্ছি, তবু শুনতে চাই তোমার মুখ থেকে।
আর কথা পেলে না-পাজী একপাল শুয়োর চরাতে এনেছি আমি।
বেশ বেশ। এবার বলো তো, এই শুয়োরগুলোকেই চামড়া ছাড়িয়ে, ধুয়ে পরিষ্কার করে যখন টেবিলে রাখা হবে তখন কি বলা হবে?
এ আবার কি ধরনের প্রশ্ন! পর্ক বলা হবে।
তাহলেই বোঝো, তোমার মতো স্যাক্সনরা যখন চরাতে নিয়ে আসে, তখন ওরা থাকে শুয়োরের পাল। কিন্তু যখন নরম্যান প্রভুদ্দে পেটে যাওয়ার জন্যে টেবিলে ওঠে তখনই হয়ে দাঁড়ায় পর্ক। তেমনিভাবে বঁড় হয় বিফ, সাধারণ বাছুর হয়ে যায়। তাই বলছিলাম, যেমন চরছে চরুক না, কদিন বাদেই তো ওদের নরম্যান নামকরণ হবে পর্ক।
ইতোমধ্যে ফ্যাংসের সহায়তায় শুয়োরগুলোকে এক জায়গায় জড় করতে পেরেছে গাৰ্থ। ওয়ার কথা শুনে বিরক্তি ওরা চোখে তাকাল ওর দিকে।
যত সব ফাঁকিবাজি কথা! বললো সে।
এ-সময় দূর থেকে ভেসে এলো অনেকগুলো ঘোড়ার খুরের আওয়াজ।
আরে, কারা যেন আসছে! ওয়াম্বা বলে উঠলো। মনে হচ্ছে এদিকেই!
গার্থ বললো, যে খুশি আসুক, তাতে তোমার কি? বিরক্তি এখনো কাটেনি তার।
আমার আবার কি? একবার দেখলে দোষ আছে কোনো?
গাধা! আকাশের দিকে তাকাও, দেখতে পাচ্ছে না, কি সাংঘাতিক ঝড় আসছে? ঐ দেখ বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে! ঐ শোনো বাজের আওয়াজ!
গার্থের কথা শেষ হতে না হতেই বড় বড় ফোঁটায় বৃষ্টি শুরু হলো। উঠে দাঁড়ালো ওয়া। কিন্তু তাড়াহুড়োর কোনো লক্ষণ দেখা গেল না তার ভেতর। ধীর স্থির ভঙ্গিতে গার্থের পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। ওর সাথে সাথে বয়োরের পাল তাড়িয়ে নিয়ে চললো সে-ও।
ঘোড়ার পায়ের আওয়াজ ক্রমশ কাছিয়ে আসছে। কৌতূহল বেড়ে উঠলো ওয়ার। একটু একটু করে পিছিয়ে পড়লো সে।
কি হলো, ওয়াম্বা, তাড়াতাড়ি এসো, তাড়া লাগালো গাৰ্থ। এক্ষুণি ঝড় বাদল শুরু হয়ে যাবে।
ওর কথা কানে নিলো না ওয়া। পিছিয়েই রইলো সে। মাঝে মাঝে পেছন ফিরে তাকাচ্ছে।
কিছুক্ষণের ভেতর ওদের ধরে ফেললো অশ্বারোহীরা।
.
সংখ্যায় তারা দশজন। একেবারে সামনের দুজন, দেখলেই বোঝা যায় হোমরা চোমরা গোছের লোক। বাকিরা তাদের সহযাত্রী বা অনুচর। দুজনের একজন ধর্মযাজক, বেশ উঁচু পদমর্যাদার। মোটাসোটা লোকটার মাংসল লাল মুখে সদা প্রসন্ন ভাব। দামী কাপড়ের গাউন পরনে, হাতা এবং গলার কিনারাগুলোয় দামী ফার লাগানো। কলারে আঁটা বড় একটা সোনার কাঁটা। অনায়াস দক্ষতায় তেজী ঘোড়াটাকে চালিয়ে আসছেন তিনি। সঙ্গে দুজন ভৃত্য। পিঠে মালপত্র চাপানো দুটো ঘোড়া টেনে আনছে তারা। এই দুই ভূত্যের পেছন পেছন আসছে ধর্মযাজকের অপর দুই সঙ্গী, দুজন পুরোহিত।