এদিকে রাজপুত্র জন আজকের প্রতিযোগিতার সমাপ্তি ঘোষণা করার কথা ভাবছেন। মনে মনে ঠিক করে ফেলেছেন, নাইট টেম্পলার ব্রায়ান দ্য বোয়া-গিলবার্টকেই সবচেয়ে সাহসী ও দক্ষ যোদ্ধা বলে ঘোষণা করবেন। বিচারকরাও যে সেই রায়ই দেবেন তাতে সন্দেহ নেই। কারণ, মাত্র একটা বর্শা দিয়ে সে দুজন প্রতিদ্বন্দ্বীকে ধরাশায়ী করেছে। তৃতীয় প্রতিদ্বন্দ্বীর সাথে লড়ার সময়ও তাকে নতুন বর্শা নিতে হয়নি। সুতরাং দক্ষতায় সে যে শ্রেষ্ঠ বিবেচিত হবে তাতে আর আশ্চর্য কি।
বিজয়ীর নাম ঘোষণা করার জন্যে ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালেন তিনি।
০৫. তীক্ষ্ণ ট্রাম্পেটের আওয়াজ
হঠাৎ উত্তর দিকের তাঁবুগুলো থেকে ভেসে এলো তীক্ষ্ণ ট্রাম্পেটের আওয়াজ।
চমকে উঠলো দর্শকরা। ট্রাম্পেটের আওয়াজ মানে নতুন কোনো প্রতিযোগী আসছে। কে?
প্রতিটা চোখ তাকিয়ে আছে উত্তর প্রান্তের প্রবেশ পথের দিকে। তরুণ এক নাইট দুলকি চালে ঘোড়া ছুটিয়ে এগিয়ে এলো। বিশাল সুন্দর, তেজী একটা কালো ঘোড়ার পিঠে বসে আছে সে আবার জাগলো প্রশ্নটা দর্শকদের মনে, কে হতে পারে?
পায়ের নখ থেকে মাথার চুল পর্যন্ত বর্মে ঢাকা তরুণ নাইটের। সারা শরীর বর্মে ঢাকা থাকলেও টের পাওয়া যাচ্ছে মানুষটা খুব মোটা তাজা নয়। বরং একটু ক্ষীণদেহীই। হাতের ঢালে খোদাই করা একটা শিকড় সহ ওপড়ানো ওক গাছের ছবি। নিচে স্প্যানিশ ভাষায় লেখা একটা মাত্র শব্দ: দেসদিচাদো দুটো, অর্থ হতে পারে শব্দটার-মূলোৎপাটিত বা উত্তরাধিকার-বঞ্চিত।
ঘেরা জায়গাটার মাঝখানে চলে এলো সে। রাজপুত্র জন ও মহিলাদের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় বর্শা নিচু করে অভিবাদন জানালো। মাথাটা রহলো গর্বিত মোরগের মাথার মতোই খাড়া। দর্শকরা খুবই পছন্দ করলো তার এই ভঙ্গি। মহা উল্লাসে চিৎকার করে উঠলো তারা।
বোয়া-গিলবার্টের সাথে লেগো না!
ফ্ৰঁত দ্য বোয়েফ-এর সাথে না!
দ্য ভাইপন্টকে বেছে নাও! ওকে কাবু করা সহজ হবে।
দীর্ঘদেহী অজানা এই নাইটের সাহসে মুগ্ধ দর্শকরা। অদ্ভুত এক মায়াও অনুভব করছে তার জন্যে। তাই আন্তরিকভাবে পরামর্শ দিচ্ছে। তারা।
এগিয়ে গেল নাইট চ্যালেঞ্জারদের দিকে। এবং সবাইকে অবাক করে দিয়ে বর্শার ফলা ছোঁয়ালো ব্রায়ানের তালে। অর্থাৎ দুজনের একজন মারা না যাওয়া পর্যন্ত সে লড়বে। আতঙ্কের এক অদ্ভুত শিহরণ বয়ে গেল দর্শকদের শিরা উপশিরা দিয়ে। করলো কি তরুণ নাইট! টেম্পলার ব্রায়ানের মতো দুর্ধর্ষ যোদ্ধার ঢাল স্পর্শ করলো বর্শার ফলা দিয়ে!
ব্রায়ান নিজেও কম বিস্মিত হয়নি। এগিয়ে এসে তরুণ নাইটকে সে বললো, তোমার সাহসের তারিফ না করে পারছি না, নাইট। এখানে আসার আগে শেষবারের মতো প্রার্থনা করে এসেছো তো? না করলে এখনই করে নাও, নইলে জীবনে আর কখনো করার সুযোগ পাবে না।
দেখুন, স্যার টেম্পলার, দৃঢ় কণ্ঠে জবাব দিলো তরুণ নাইট, মৃত্যুকে আমি আপনার চেয়ে কমই ভয় করি।
বেশ, তাহলে তৈরি হও, নাইট। সূর্যের দিকে, এই পৃথিবীর দিকে শেষবারের মতো একবার তাকিয়ে নাও। কাল আর এগুলো দেখার সৌভাগ্য তোমার হবে না।
আপনার পরামর্শের জন্যে অসংখ্য ধন্যবাদ। বিনিময়ে আপনাকেও একটা পরামর্শ দিচ্ছি, দয়া করে নতুন ঘোড়া আর নতুন বর্শা নিয়ে লড়াইয়ে নামুন। এখন যদি জেদ করে না-ও নেন, আমি বলছি, কিছুক্ষণের ভেতর আপনাকে নিতেই হবে।
আর অপেক্ষা করলো না নাইট। অদ্ভুত দক্ষতায় ঘোড়াটাকে ধীরে ধীরে পেছনে হাঁটিয়ে রণক্ষেত্রের উত্তর প্রান্তে গিয়ে দাঁড়ালো। ঘোড়া চালানোর এই নূতন কৌশল দেখে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলো দর্শকরা। করতালি আর উৎফুল্ল চিৎকারে মুখর হয়ে উঠলো চারদিক।
তরুণ নাইটের পরামর্শ শুনে প্রথমে খুব রেগে গেল ব্রায়ান। পরে ভেবে দেখলো, কথাটা নাইট ঠিকই বলেছে। এই ঘোড়া আর বর্শা নিয়েই একটু আগে তিন তিন জন যোদ্ধার মোকাবেলা করেছে সে। এখন আর এগুলোর ওপর ততটা নির্ভর করা ঠিক নয়। তাতে শত্রুকে খামোকা সুযোগ দেওয়া হবে। শেষ পর্যন্ত সে তার তাঁবুতে গিয়ে ঢুকলো।
তরুণ নাইট অপেক্ষা করছে। দর্শকরা অপেক্ষা করছে। অবশেষে বেরিয়ে এলো স্যার ব্রায়ান তাঁবুর ভেতর থেকে। তার হাতে নতুন একটা বর্শা। দেখা গেল ঢালটাও বদলে নিয়েছে সে। এটার ওপর খোদাই করা মড়ার খুলি ঠোঁটে একটা উড়ন্ত দাঁড়কাকের ছবি। নিচে লেখা: সাবধান, দাঁড়কাক করে দেবে। ভৃত্য নতুন একটা ঘোড়া নিয়ে এলো। চড়ে বসলো ব্রায়ান। ধীর কদমে দক্ষিণ দিকের প্রবেশ পথ পেরিয়ে প্রতিযোগিতা স্থানে এসে দাঁড়ালো টেম্পলারের ঘোড়া।
ট্রাম্পেটের তীক্ষ্ণ আওয়াজ। প্রধান বিচারক চিৎকার করে উঠলেন:
লাইসে অ্যালের!
বিদ্যুৎচমকের মতো ছুটলো দুই নাইটের ঘোড়া একে অন্যের দিকে। মাঠের মাঝখানে মিলিত হলো দুজন। বজ্রগর্জন তুলে দুজনের ঢালে আঘাত হানলো দুজনের বর্শা। দুজনই এমন প্রচণ্ড শক্তিতে বর্শা চালিয়েছে যে দুজনেরটাই ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে। দুজনই ঘোড়া থেকে ছিটকে পড়তে পড়তে সামলে নিলো কোনোমতে। হিংস্র চোখে তাকিয়ে আছে দুজন দুজনের দিকে।
দর্শকরা রুদ্ধশ্বাসে দেখছে। তাদের বেশির ভাগেরই ধারণা, যত নৈপুণ্যই দেখাক শেষ পর্যন্ত তরুণ মাইটকে হার স্বীকার করতেই হবে অভিজ্ঞ ব্রায়ানের কাছে। তবু তারা মুগ্ধ চোখে দেখছে তরুণের আক্রমণ।