এদিকে পাঁচ চ্যালেঞ্জার বেরিয়ে এসেছে যার যার তাঁবু থেকে। নিজের নিজের ঢাল তুলে নিয়ে ঘোড়ায় চাপলো তারা। ধীর কদমে ঘোড় চালিয়ে প্রবেশ করলো প্রতিযোগিতার জন্যে নির্দিষ্ট জায়গায়। দর্শকরা আরেকবার ফেটে পড়লো উল্লাস আর করতালিতে। প্রতিদ্বন্দ্বীদের সামনাসামনি একই ভঙ্গিতে ঘোড়াগুলোকে পাশাপাশি দাঁড় করিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলো চ্যালেঞ্জাররা।
রাজপুত্রের আরেকটা ইঙ্গিত পেলেই শুরু হবে লড়াই।
বিচারকমণ্ডলী তাকিয়ে আছেন রাজপুত্রের দিকে। রাজপুত্রও তাকিয়ে আছেন বিচারকদের দিকে। ঘাড় ঘুরিয়ে শেষবারের মতো একবার প্রতিদ্বন্দ্বীদের দিকে তাকালেন তিনি, চ্যালেঞ্জারদের দিকেও তাকালেন। হ্যাঁ, তৈরি সবাই। সম্মতি দেয়ার ভঙ্গিতে সামান্য মাথা নোয়ালেন জন।
ল্যাইসে অ্যালের! নরম্যান ভাষায় চিৎকার করে উঠলেন প্রধান বিচারক, অর্থাৎ, শুরু কর!
দুই সারি ঘোড়সওয়ার ভয়ঙ্কর বেগে ছুটলো একে অন্যের দিকে। প্রতিযোগিতা ক্ষেত্রের মাঝখানে এসে মিলিত হলো তারা। প্রত্যেকেই নিজের বর্শা দিয়ে প্রতিপক্ষের বর্মে আঘাত করার চেষ্টা করছে। দর্শকরা রুদ্ধশ্বাসে তাকিয়ে আছে। সবাই আশা করছে দারুণ একখানা লড়াই দেখতে পাবে। কিন্তু হতাশ হতে হলো তাদের। চ্যালেঞ্জাররা সত্যিই প্রতিদ্বন্দ্বী নাইটদের চেয়ে অনেক উঁচুদরের যোদ্ধা। কয়েক মিনিটের মধ্যেই চারজন প্রতিদ্বন্দ্বী পরাজয় বরণ করতে বাধ্য হলো। একমাত্র ভাইপন্টের প্রতিদ্বন্দ্বীই কিছুক্ষণ টিকলো। দুজনের মধ্যে আক্রমণ ও প্রতিআক্রমণ চলতে লাগলো। শেষ পর্যন্ত দুজনের বর্শাই যখন দুটুকরো হয়ে গেল, থামলো লড়াই।
বিচারকমণ্ডলী চ্যালেঞ্জারদেরই বিজয়ী বলে ঘোষণা করলেন। বুনো উল্লাসে ফেটে পড়লো দর্শকরা।
পরাজিত নাইটরা তাদের ঘোড়া ও অস্ত্রশস্ত্র বিজয়ীদের হাতে তুলে দিয়ে বিরস মুখে ফিরে গেল নিজেদের জায়গায়। চ্যালেঞ্জারদের ভৃত্যরা এসে সেগুলো নিয়ে রাখলো যার যার তাঁবুতে।
কিছুক্ষণ পর আরো পাঁচজন নাইট এগিয়ে এলো চ্যালেঞ্জারদের সাথে লড়বার জন্যে। তারাও অল্প সময়ের মধ্যেই পরাজিত হয়ে ফিরে গেল নিজেদের জায়গায়। এরপর এলো তৃতীয় দল। সেই একই পরিণতি তাদেরও। চতুর্থ দলে এলো মাত্র তিনজন। তারা ব্রায়ান ও রেজিনান্ডকে বাদ দিয়ে অন্য তিন চ্যালেঞ্জারের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামলো। পরাজিত হতে হলো তাদেরও।
এরপর দীর্ঘ সময়ের বিরতি। চ্যালেঞ্জাররা বিশ্রাম নেবে। খোশগল্পে মেতে উঠলো দর্শকরা। যারা সঙ্গে খাবার দাবার এনেছে তারা খেয়ে নিলো। একটু আগে হয়ে যাওয়া লড়াই নিয়ে আলোচনা করছে অনেকে চ্যালেঞ্জারদের বিজয়ে তারা খুশি হতে পারেনি। বদ মেজাজের কারণে রেজিনাল্ড ও ম্যালভয়সিঁকে তারা দুচক্ষে দেখতে পারে না। বিদেশী বলে গ্র্যান্টমেনসিলকেও খুব একটা পছন্দ নয় কমরো। তাই মনে মনে ওদের পরাজয়ই কামনা করেছিলো তারা। কিন্তু ঘটছে উল্টো। সবাই আশা করছে, আগামী লড়াইতে নিশ্চয়ই কেউ একজন পরাজিত করতে পারবে চ্যালেঞ্জারদের কাউকে না কাউকে।
শেষ হলো বিরতি।
দর্শকরা আবার টগবগ করতে লাগলো উত্তেজনায়। নতুন করে লড়াই শুরু হতে যাচ্ছে। চ্যালেঞ্জাররা একে একে ঢুকলো প্রতিযোগিতার জাগায়। আগের মতোই পাশাপাশি সার বেঁধে দাঁড়ালো তারা। এবার প্রতিদ্বন্দ্বী নাইটরা চলে এলেই হয়।
কিন্তু কোথায় প্রতিদ্বন্দ্বী? একটা দুটো করে বেশ কয়েকটা মিনিট পেরিয়ে গেল। উত্তর দিক থেকে এগিয়ে এলো না কোনো নাইট। হতাশ হয়ে পড়তে লাগলো দর্শকরা। সেই সাথে বাড়তে লাগলো তাদের অস্থির চিৎকার।
সবচেয়ে হতাশ হলেন সেড্রিক। কারণ তার কাছে চ্যালেঞ্জারদের বিজয় মানে নরম্যানদের বিজয়। আর নরম্যানদের বিজয় মানে স্যাক্সনদের অপমান। সব ধরনের অস্ত্র চালনায় মোটামুটি পারদর্শী সেড্রিক। তবে টুর্নামেন্টে লড়ার জন্যে যে ধরনের দক্ষতা, দরকার তা তার নেই। তাই নিজে প্রতিযোগিতায় নামতে না পেরে মনে মনে উসখুস করছেন তিনি।
সেড্রিকের পাশেই বসে আছে স্যাক্সন রাজকুমার অ্যাথেলস্টেন। এ ধরনের লড়াইয়ে বিশেষ নৈপুণ্য আছে তার। কিন্তু এ মুহূর্তে প্রতিযোগিতায় নামার কোনো ইচ্ছা দেখা যাচ্ছে না অ্যাথেলস্টেনের ভেতর। সেড্রিক এতক্ষণ আকারে ইঙ্গিতে প্ররোচিত করার চেষ্টা করেছেন তাকে। কিন্তু লাভ হয়নি।
অ্যাথেলস্টেন, নরম্যানরা সব জিতে যাচ্ছে, শেষ পর্যন্ত সেড্রিক সরাসরিই বললেন, স্যাক্সনদের পক্ষ থেকে তুমি লড়বে না?
শক্তিমান, সাহসী ও লড়াইয়ে নিপুণ হলেও একটু অলস প্রকৃতির মানুষ অ্যাথেলস্টেন। তাছাড়া উচ্চাকাঙ্ক্ষা বা নামের মোহও তার নেই।
না, সেড্রিকের প্রশ্নের জবাবে সে বললো। কাল পর্যন্ত আমি অপেক্ষা করবো। যদি লড়তেই হয়, তো তারপর লড়বো।
মনে মনে চুপসে গেলেন সেড্রিক। একটু ক্ষুন্নও হলেন। কিন্তু এ নিয়ে আর কথা বাড়ালেন না। বয়েসে ছোট হলেও অ্যাথেলস্টেনকে তিনি সমীহ করে চলেন।
দর্শকরা অপেক্ষা করছে। এখনও তারা আশা করছে, যে কোনো মুহূর্তে কোনো দুঃসাহসী নাইট এগিয়ে আসবে চ্যালেঞ্জারদের সাথে লড়াইয়ের জন্যে। অনেকে নিজেদের ভেতর বলাবলি করছে, এই সামান্য লড়াই দেখার জন্যে এতদূর আসাই ভুল হয়েছে। বৃদ্ধ নাইটরা আক্ষেপ করছেন, আজকালকার তরুণরা তারা যেমন ছিলেন তেমন সাহসী নয়। হারা জেতা পরের কথা, প্রতিযোগিতায় নামার সাহস তো আগে দেখাতে হবে।