নাইট টেম্পলার এবং সেইন্ট জন গির্জার সাথে জড়িত নাইটরা প্যালেস্টাইনে থাকতে সব সময়ই রাজা রিচার্ডের বিরোধিতা করেছেন। যুদ্ধ সংক্রান্ত বিষয়ে রিচার্ড যে সিদ্ধান্তই নিয়েছেন, ভুল হোক ঠিক থোক, তাদের পছন্দ হয়নি। এর একটা কারণ সম্ভবত রিচার্ডকে ব্যক্তিগতভাবে তাদের কেউই পছন্দ করেন না। কারণ রিচার্ড নরম্যান গোত্রের লোক হওয়া সত্ত্বেও স্যাক্সন নরম্যানে কোনো ভেদ কখনো করেননি। একজন নরম্যানকে তিনি যে চোখে দেখেন স্যাক্সনকেও সে চোখেই দেখেন। ব্যাপারটা কিছুতেই মানতে পারেন না নরম্যান নাইট, নাইট টেম্পলাররা। ফলে রিচার্ডের সঠিক সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেছেন তারা। আর এ কারণেই ব্যর্থ হয়েছে এবারের ক্রুসেডও। সিরিয়ার সুলতানের সাথে সন্ধি করেই সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছে খ্রীষ্টান পক্ষকে।
রিচার্ড এখনো দেশে ফেরেননি। কোনো দিন যে ফিরবেন সে কথাও জোর করে কেউ বলতে পারে না। জনশ্রুতি, তাঁকে নাকি বন্দী করে নিয়ে যাওয়া হয়েছে ফ্রান্সে। তবে তার বিরোধী অনেক নাইট, নাইট টেম্পলার ফিরে এসেছেন। এবং এসেই, রিচার্ডের বিরুদ্ধে খেপিয়ে তুলতে শুরু করেছেন জনকে। জনের মানসিকতা রিচার্ডের ঠিক উল্টো। স্যাক্সনদের তিনি দুই চোখে দেখতে পারেন না, নরম্যানরাই তাঁর কাছে সব। তাছাড়া রিচার্ডের অনুপস্থিতিতে দেশ শাসন করে সিংহাসনের প্রতি একটা লোভ জন্মে গেছে তার। এই কবছর কারো কাছ থেকে কোনো বাধা না পেয়ে অস্বাভাবিক বিলাস ব্যসনের ভেতর জীবন কাটাতে অভ্যস্ত হয়ে গেছেন তিনি। এখন যদি ভাই দেশে ফিরে শাসন ক্ষমতা কেড়ে নেন খুবই অসুবিধা হয়ে যাবে তাঁর। তাই হঠাৎ করে চার পাশে ভাইয়ের বিরোধী এতগুলো বীরকে পেয়ে খুশি হয়ে উঠেছেন জন। স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছেন পাকাঁপাকি ভাবে সিংহাসনে বসার।
অত্যন্ত সুপুরুষ রাজকুমার জন। লাল আর সোনালিতে মেশানো জমকালো পোশাক পরনে। তেজী একটা ধূসর রঙের ঘোড়ায় চেপে তিনি আসছেন। পেছনে তাঁর সঙ্গীরা।
প্রথমেই ধীর গতিতে ঘোড়া চালিয়ে প্রতিযোগিতা স্থানটার চারপাশে একটা চক্কর লাগালেন জন। মেজাজটা আজ তাঁর খুব ভালো। মহিলাদের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলেন তাঁদের। কাকে আজকের সৌন্দর্য ও প্রেমের রানী করা যায় ভাবছে। হঠাৎ নজরে পড়লো ভীড়ের ভেতর এক জায়গায় দাঁড়িয়ে আছেন আইজাক। সঙ্গে এক তরুণী। তরুণীর সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হয়ে গেলেন জন। তাঁর মনে হলো, সারা ইংল্যান্ডে এমন সুন্দরী দ্বিতীয়টি আছে কিনা সন্দেহ। মুখে প্রকাশ করতেও ছাড়লেন না সে কথা।
এমন রূপ দেখে সাধু সন্ন্যাসীদেরও মন ভোলে, কি বলেন, ফাদার? প্রায়োর অ্যায়মারের দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন।
কি বলছেন, মহানুভব! বিস্ময় প্রকাশ করলেন ফাদার। ও তো ইহুদীর মেয়ে!
ইহুদী হোক আর যে-ই হোক, অমন সুন্দরীর স্থান এই ভীড়ের ভেতর হতে পারে না, ওর জন্যে আসমের ব্যবস্থা করতে হবে। আইজাকের কাছে গিয়ে জন জিজ্ঞেস করলেন, মেয়েটি কে
আজানু নত হয়ে কুর্নিশ করলেন আইজাক। মহানুভব, এ আমার মেয়ে রেবেকা।
আচ্ছা! তোমার মেয়ে! সামনে একটা আসনে বসে থাকা এক লোকের দিকে তাকিয়ে হাঁক ছাড়লেন জন, এই, কে ওখানে? সরে বসো, এদের বসার জায়গা করে দাও।
লোকটা, একজন স্যাক্সন। সেড্রিকের দূর সম্পর্কের আত্মীয় এবং সুহৃদ কনিংসবার্গের অ্যাথেস্টেন। ইংল্যান্ডের শেষ স্যাক্সন রাজার বংশধর বলে সমাজে তার বিশেষ মর্যাদা আছে। জনের কথা শুনে রীতিমতো অপমানিত বোধ করলো সে। একটু বিব্রতও হলো। সরে বসার কোনো লক্ষণ না দেখিয়ে সে তাকিয়ে রইলোরাজপুত্রের দিকে। চোখে ক্ষুব্ধ দৃষ্টি।
অ্যাথেলস্টেন-এর এই ঔদ্ধত্যে ভয়ানক চটে গেলেন জন।
এই, গর্দভ, আমার কথা কানে ঢোকেনি? চিৎকার করলেন তিনি। তারপর এক সঙ্গীকে হুকুম দিলেম, বর্শার ডগা দিয়ে ঠেলে ওকে সরিয়ে দাও তো, দ্য ব্রেসি।
হুকুম পাওয়া মাত্র তামিল করতে লেগে গেল দ্য ব্রেসি। বর্শা বাগিয়ে ছুটলো অ্যাথেলস্টেনের দিকে। এবার আর বসে রইলো না অ্যাথেলস্টেন, চট করে সরে গেল এক পাশে। কাছেই বসে ছিলেন সেড্রিক। দ্য ব্রেসিকে। ছুটে আসতে দেখে লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছেন তিনি। খাপ থেকে তলোয়ার বের করে সর্বশক্তিতে চালালেন ব্রেসির বর্শা লক্ষ্য করে। দুটুকরো হয়ে গেল বর্শাটা। এক টুকরো ব্রেসির হাতে ধরা রইলো, ফলা সহ অন্য টুকরোটা ছিটকে পড়লো মাটিতে।
ভয়ঙ্কর রাগে চোখ মুখ লাল হয়ে উঠলো জনের। চিৎকার করে সেড্রিকের জন্যে কিছু একটা শাস্তি ঘোষণা করতে যাচ্ছিলেন। কিন্তু সঙ্গীদের, বিশেষ করে প্রায়োর অ্যায়মারের কথায় সামলে নিলেন। এদিকে সেড্রিকের দুঃসাহস দেখে উপস্থিত স্যাক্সনরা খুব খুশি। রাজপুত্র জনের সামনেই অনেকে বলাবলি করছে, জমিদার আজ কাজের মতো কাজ করেছে একটা।
সহচরদের ওপর ক্ষুব্ধ হয়েছেন জন, কিন্তু কিছু বলতে পারছেন না। পাকাঁপাকিভাবে সিংহাসনে বসতে হলে এদের সমর্থন তাঁর লাগবে। এদিকে সেড্রিকের অপমানটা মুখ বুজে হজম করে ফেলতেও ইচ্ছে হচ্ছে না। মনের ঝালটা অন্য কার ওপর ঝাড়া যায় ভাবছেন, এমন সময় চোখ পড়লো এক তীরন্দাজের ওপর। লোকটা এখনো চিৎকার করে বাহবা দিচ্ছে সেড্রিককে। তার দিকে এগিয়ে গেলেন রাজপুত্র।