উত্তর দিকের প্রবেশ পথের কাছে আর এক সারি তাঁবু। ওগুলোও চমক্কার করে সাজানো। চ্যালেঞ্জারদের মোকাবেলা করবে যেসব নাইট তাদের তাবু ওগুলো।
ঘেরা জায়গার অন্য দুপাশে অর্থাৎ পূর্ব-পশ্চিমে দর্শকদের জন্যে আসন সাজানো হয়েছে। সেরা আসনগুলো নাইট এবং ভদ্রলোকদের জন্যে সংরক্ষিত। অন্যগুলোয় বসবেন ভদ্রমহিলারা। সাধারণ মানুষ, কৃষক, ব্যবসায়ী বা শ্রমজীবীদের জন্যে কোনো আসরে ব্যবস্থা করা হয়নি। তারা যে যেখানে পারে বসে বা দাঁড়িয়ে প্রতিযোগিতা দেখবে।
সংরক্ষিত আসনগুলোর একটা একটু উঁচু এবং সুসজ্জিত। ছোট্ট একটা তাবুর সামনে পাতা আসনটা। তাঁবুর বাইরে রাজকীয় প্রতীক চিহ্ন। এই তাবুর পাহারায় যারা রয়েছে তাদের পরনে ঝলমলে পোশাক। হাতে বর্শা। কোমরে খাপে পোরা তলোয়ার। তবুটা নির্দিষ্ট রাজকুমার জনের জন্যে, আসনটাও। এটার ঠিক উল্টোদিকে আরেকটা জমকালো ভাবু। সেটার সামনে সুদৃশ্য এক সিংহাসন পাতা। কয়েকজন তরুণী পরিচারিকা সুন্দর পোশাকে সেজে দাঁড়িয়ে আছে তাবুটার দুপাশে। তাবুর উপরে অনেকগুলো তিনকোনা পতাকা। নানা রকমের ছবি আঁকা সেগুলোয়। একটায় আঁকা তীর-ধনুক। তাঁবুর দরজার ওপরে লেখা: সৌন্দর্য ও প্রেমের রানী। আজ যাঁকে রানী নির্বাচিত করা হবে তিনি পুরস্কার বিতরণ করবেন টুর্নামেন্টের বিজয়ীদের ভেতর। রানী নির্বাচনের ব্যাপারে বিজয়ীর অধিকার সবচেয়ে আগে। দর্শকদের ভেতর তুমুল জল্পনা কল্পনা চলছে, কে আজ বিজয়ী হবেন, আর কে-ই বা নির্বাচিত হবেন সৌন্দর্য ও প্রেমের রানী?
এর ভেতর সবগুলো আসন পূর্ণ হয়ে গেছে নাইট এবং অন্যান্য গণ্যমান্য দর্শকে। তাদের পোশাক আশাকের চাকচিক্যে চোখ ঝলসে যেতে চায়। মহিলা দর্শকও কম নয়। রুচিসম্মত জমকালো পোশাকে সজ্জিত সবাই। আসন-সারির পেছনে, গাছের ডালে, পাশের টিলায়, কাছের এক গির্জার বারান্দায় দাঁড়িয়ে বসে সাধারণ মানুষরা। সংখ্যায় তারা অসংখ্য। এখন্ও দলে দলে লোক আসছেই। যারা মাটিতে দাঁড়িয়ে আছে তাদের ভেতর ঠেলাঠেলি চলছে–একটু এগিয়ে যদি যাওয়া যায়, হয়তো ভালো করে দেখা যাবে লড়াই। কথা কাটাকাটি চলছে অনেকের ভেতর, মুখখিস্তিও চলছে সমানে। আইন শৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত রক্ষীরা হিমসিম খেয়ে যাচ্ছে এসব ঝগড়া বিবাদ মিটিয়ে শান্তি রক্ষা করতে। যেখানে কথায় কাজ হচ্ছে না সেখানে নির্বিচারে লাঠি চালাচ্ছে তারা।
এক জায়গায় দেখা গেল বয়স্ক এক দর্শক আরেক বয়স্ক–প্রায় বৃদ্ধ দর্শককে গালাগাল করছে; বিধর্মী কুকুর! তোর এত বড় সাহস, আমার মতো একজন নরম্যান ভদ্রলোকের পাশে বসতে চাস!
যে বৃদ্ধকে ধমকানো হচ্ছে তিনি আর কেউ নন, ইহুদী আইজাক। এখন তার গায়ে দামী জমকালো পোশাক। বৃদ্ধ তাঁর মেয়ে রেবেকাকে সামনে বসানোর চেষ্টা করছিলেন, তাতেই এই বিপত্তি।
আইজাকের চেহারায় আগের সেই ভীত ভাব আর নেই। কারণ তিনি জানেন, আইনের চোখে এখানে ইহুদী আর খ্রীষ্টানে কোনো প্রভেদ নেই। তার ওপর কোনো অন্যায় অত্যাচার হলে অনেকেই সাহায্যের হাত বাড়িয়ে এগিয়ে আসবে। তাছাড়া, অভিজাতদের অনেকেই প্রয়োজনের সময় ইহুদীদের কাছ থেকে টাকা ধার নেয়। সুতরাং নিজেদের স্বার্থেই তারা তাকে রক্ষা করবে। সবচেয়ে বড় কথা, রাজকুমার জন ইয়র্কের ইহুদীদের কাছ থেকে ক্লেশ মোটা অঙ্কের একটা ঋণ নেয়ার জন্যে আলাপ আলোচনা চালাচ্ছেন। সেই ঋণের সিংহভাগ দেয়ার কথা আইজাকেরই। কাজেই ধার পেতে যাতে কোনো অসুবিধা না হয় সেজন্যে খোদ জনও নিজের গরজে এগিয়ে আসবেন বৃদ্ধ ইহুদীকে সাহায্য করতে।
এসব কথা ভেবে নরম্যান লোকটাকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করলেন আইজাক। লোকটা তখন রক্ষীদের শরণাপন্ন হলো। এক সাথে ছুটে এলো দুতিনজন রক্ষী।
টাকার গরমে তোমার বুঝি পা মাটিতে পড়তে চাইছে না? হুঙ্কার ছাড়লো একজন। তোমার এত বড় স্পর্ধা, যিনি আগে এসে জায়গা দখল করেছেন তাঁকে সরিয়ে দিতে চাও! গরীবদের কাছ থেকে সুদ খেয়ে পেট মোটা করেছো, ঐ মোটা পেট নিয়ে ঘরের অন্ধকারে বসে থাকোগে, যাও। বাইরে এসে গোলমাল পাকানোর চেষ্টা কোরো না। নইলে তোমার ঐ মোটা পেট আর মোটা থাকবে না, চিমসে হয়ে যাবে।
অন্য রক্ষীরা সায় দিলো তার কথায়। সমবেত দর্শকদের ভেতর থেকেও কয়েকজন হৈ-চৈ করে উঠলো, হ্যাঁ, হ্যাঁ, ঠিক বলেছেন! ব্যাটা ইহুদীর বাচ্চার এত বড় সাহস!
আইজাক বুঝলেন, পরিস্থিতি খুব একটা সুবিধার নয়। চারপাশে একবার চোখ বুলিয়ে সাহায্য করার মতো কাউকে দেখতে পেলেন না। অগত্যা মেয়েকে নিয়ে মানে মানে কেটে পড়ার কথা ভাবলেন তিনি। এই সময় ট্রাম্পেটের আওয়াজে মুখর হয়ে উঠলো আকাশ। শোরগোল উঠলো দর্শকদের ভেতর। রাজকুমার জন তার সঙ্গী-সাথীদের নিয়ে এসে পড়েছেন। সবাই ঘুরে তাকালো তার দিকে।
রাজকুমারের সঙ্গী সাথীর সংখ্যা কম নয়। নানা শ্রেণীর, নানা পেশার লোক তারা। পোশাক আশাকেও তেমনি বৈচিত্র্য। প্রায়োর অ্যায়মার তাদের অন্যতম। আজ তার পরনে স্বর্ণখচিত মূল্যবান পোশাক। অন্যদের ভেতর আছেন রাজকুমারের প্রিয় কয়েকজন সেনানায়ক, কয়েকজন অত্যাচারী ব্যারন, লম্পট অনুচর, কয়েকজন নাইট টেম্পলার আর সেইন্ট জন গির্জার নাইট।