আহ, আপনি আমাকে বাঁচালেন। ঈশ্বর আপনার ভালো করবেন।
কিন্তু একটা কথা, শেফিল্ডের ওপাশে কিন্তু আমি যেতে পারবো না। ওখানে নিশ্চয়ই আপনার জানাশোনা ইহুদী পরিবার আছে, তাদের কাছে সহজেই আপনি আশ্রয় পেয়ে যাবেন।
শেফিল্ড পর্যন্ত গেলেই চলবে। ওখানে আমার এক দূর সম্পর্কের আত্মীয় আছে। ওর বাড়িতেই আমি উঠতে পারবো।
চলুন তাহলে। আধ ঘণ্টার মধ্যেই আমরা শেফিল্ডে পৌঁছে যাবো।
আর কোনো কথা হলো না তাদের ভেতর। নিঃশব্দে পাশাপাশি ঘোড়া চালিয়ে চললো দুজন। আধঘণ্টার মাথায় পৌঁছে গেল শেফিল্ডে।
এবার আমি যাই, বললো তীর্থযাত্রী।
এই হতভাগ্য ইহুদীর ধন্যবাদ না নিয়েই?
ধন্যবাদের কোনো প্রয়োজন নেই। আপনার জন্যে যেটুকু করেছি মানুষ হিসেবে মানুষের জন্যে এটুকু করা আমার কর্তব্য।
ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে রওনা হতে গেল তীর্থযাত্রী। অমনি তার পোশাকের প্রান্ত ধরে ফেললেন আইজাক।
একটু দাঁড়ান। আপনার সহৃদয়তার প্রতিদান আমাকে দিতেই হবে। এই মুহূর্তে আপনি যা মনে প্রাণে চাইছেন আমি হয়তো তার ব্যবস্থা করে দিতে পারবো।
অবাক হলো তীর্থযাত্রী। আমি যা মনেপ্রাণে চাইছি! বলুন তো কি। চাইছি?
একটা ভালো ঘোড়া আর যুদ্ধের পোশাক আর অস্ত্র।
আপনি কি করে জানলেন!
জানি। রহস্যময় এক টুকরো হাসি উপহার দিলেন বৃদ্ধ ইহুদী।
কিন্তু কি করে? আমার সাধারণ চালচলন, অতি সাধারণ পোশাক, কথাবার্তা–সব দেখেশুনেও আপনার মনে এ সন্দেহ হলো কেন?
কাল রাতেই আমি টের পেয়েছি। আপনি যেসব কথা বলছিলেন শাদামাঠা হলেও তাতে ছিলো আগুনের ফুলকির চমক। সাধারণ একজন তীর্থযাত্রীর মুখ থেকে অমন কথা বেরোতে পারে না। তাছাড়া আজ ভোরে আপনি যখন ঝুঁকে আমাকে জাগাচ্ছিলেন তখন দেখলাম আপনার আলখাল্লার নিচে ঝুলছে নাইটদের হার। তারপর আর সন্দেহ রইলো না।
হাসলো তীর্থযাত্রী। আপনার আলখাল্লার নিচে উঁকি দিলে কি পাওয়া যাবে বলুন তো!
এ কথার কোনো উত্তর দিলেন না আইজাক। কোমরের ছোট্ট চামড়ার বাক্সটা থেকে লেখার সাজ সরঞ্জাম বের করে হিব্রু ভাষায় কি যেন লিখলেন। তীর্থযাত্রীর হাতে লেখাটা দিতে দিতে বললেন, লিস্টার শহরে এক ধনী ইহুদী আছেন, তাঁর নাম কিরজাথ জেরাম। অন্তত ছয় প্রস্থ খুব ভালো যুদ্ধের পোশাক আর অস্ত্রশস্ত্র আছে তার কাছে। এই কিরজাথ জেরামের কাছে গিয়ে আমার এই চিঠি দেখালে উনি আপনাকে এক প্রস্থ পোশাক ও অস্ত্রশস্ত্র দেবেন। ছটার ভেতর থেকে পছন্দমতো বেছে নিতে পারবেন। উনি একটা ঘোড়াও দেবেন আপনাকে। যদি দাম দিয়ে কিনে নিতে পারেন, ভালো, না হল টুর্নামেন্ট শেষে ওগুলো আপনি ফেরত দেবেন কিরজাথকে।
কিন্তু, আইজাক, তীর্থযাত্রী বললো, টুর্নামেন্টে যখন কোনো নাইট পরাজিত হয় তখন তার বর্ম, অস্ত্রশস্ত্র সব তো বিজয়ীকে দিয়ে দিতে হয়। যদি আমি হেরে যাই–
উদ্বেগের ছায়া পড়লো আইজাকের মুখে। কিন্তু মুহূর্তের জন্যে। তারপরই আবার উজ্জ্বল হয়ে উঠলো বৃদ্ধের চেহারা।
ঠিক আছে, ও নিয়ে ভাববেন না, বললেন তিনি। আপনি যদি একান্ত হেরেই যান, কিরজাথ জেরামের সাথে আমি মিটিয়ে ফেলবো ব্যাপারটা। তারপর অদ্ভুত এক সহানুভূতির দৃষ্টি ফুটে উঠলে তার চোখে। বললেন, টুর্নামেন্টে লড়ার সময় সতর্ক থাকবেন। ঘোড়া বা বর্মের কথা আমি ভাবছি না, ভাবছি আপনার অমূল্য প্রাণের কথা।
আমি সতর্ক থাকবো, বললো তীর্থযাত্রী। আপনার পরামর্শ আর সহৃদয়তার কথা কখনো ভুলবো না। সময় হলে এই উপকারের প্রতিদান আমি দেবো।
আব্রাহাম আপনার মঙ্গল করুন। আপনি জয়ী হোন এই কামনা করি।
একে অপরের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে দুই ভিন্ন পথে রওনা হলেন দুজন।
০৪. দেশের নামকরা সব নাইট
দেশের নামকরা সব নাইট যোগ দেবেন অ্যাশবির টুর্নামেন্টে। তার ওপর এতে উপস্থিত থাকবেন রাজকুমার জন, যিনি রাজা রিচার্ডের পক্ষে এখন শাসন করছেন ইংল্যান্ড। সুতরাং এ প্রতিযোগিতার গুরুত্ব আর দশটা সাধারণ টুর্নামেন্টের চেয়ে অনেক বেশি। নির্দিষ্ট দিনে ভোর থেকেই দলে দলে লোক উপস্থিত হতে লাগলো প্রতিযোগিতার জন্যে নির্ধারিত জায়গায়। বিচিত্র পোশাক-আশাক পরা নানা শ্রেণীর সব দর্শক।
টুর্নামেন্ট হবে অ্যাশবি শহরের ঠিক বাইরে এক বিস্তীর্ণ প্রান্তরে। প্রান্তরের এক ধারে বড় বড় ওক গাছের সারি। অন্য পাশে নিবিড় বনভূমি। মাঝখানে নির্দিষ্ট হয়েছে প্রতিযোগিতার স্থান। সুঁচালো মাথাওয়ালা শক্ত কাঠের খুঁটি পুঁতে ঘিরে ফেলা হয়েছে আধ মাইল লম্বা সিকি মাইল চওড়া জায়গাটা। উত্তর দক্ষিণে প্রবেশ পথ। এক সাথে দুজন যোদ্ধা পাশাপাশি যেতে পারে এই পথ দিয়ে। দুই প্রবেশ দ্বারের দুপাশে দাঁড়িয়ে আছে একজন করে থোক। প্রতিযোগীরা যখন ভেতরে ঢুকবেন তাদের নাম পরিচয় ঘোষণা করবে ওরা। পুরো প্রতিযোগিতাস্থানটাকে ঘিরে আছে অসংখ্য সশস্ত্র রক্ষী। কোনো গোলমাল হলে শৃঙ্খলা রক্ষা করবে তারা।
দক্ষিণ দিকের প্রবেশ পথের কাছে এক সারিতে পাচটা তাঁবু। আজকের টুর্নামেন্টের পাছ চ্যালেঞ্জার স্যার ব্রায়ান দ্য বোয়া-গিলবার্ট, রেজিনাল্ড ট্রুত দ্য বোয়েফ, ফিলিপ ম্যালভয়সিঁ, স্যার গ্রান্টমেনসিল ও জেরুজালেমের সেইন্ট জন গির্জার নাইট ভাইপন্টের তাঁবু এগুলো। এই পাঁচজন ছাড়া আর যারা টুর্নামেন্টে যোগ দেবে তাদেরকে এই পাঁচজনের একজনকে পছন্দ করে তার সাথেই লড়তে হবে।