দেখুন, সত্যি কথা বলতে কি আইভানহো সম্পর্কে সামান্যই জানি আমি, জবাব দিলো তীর্থযাত্রী। আপনি ওর ব্যাপারে কৌতূহলী জানলে আরেকটু খোঁজ খবর করে আসতে পারতাম বোধহয়।
খুব শিগগিরই কি দেশে ফিরবে? আগ্রহের সঙ্গে জানতে চাইলে রোয়েনা।
বোধ হয়। আমার ধারণা এখন উনি ইংল্যান্ডে ফেরার আয়োজনেই ব্যস্ত।
ওহ, তাড়াতাড়ি আসুক! নইলে এসে হয়তো দুঃসংবাদ শুনতে হবে ওকে। বাবা অ্যাধেলস্টেনের সাথে আমার বিয়ে ঠিক করছে। আমার কি করার আছে? শেষ কথাগুলো যেন নিজেকে শোনানোর জন্যেই বললো রোয়েনা। অ লুকানোর জন্যে অন্য দিকে মুখ ফেরালো সে।
তীর্থযাত্রী দাঁড়িয়ে রইলো চুপচাপ। কি করবে কিছু বুঝতে পারছে না যেন।
কয়েক সেকেন্ড লাগলো রোয়েনার নিজেকে সামলাতে। চোখ মুছে আবার তাকালো তরুণ তীর্থযাত্রীর দিকে।
আচ্ছা, ওর সঙ্গে যখন আপনার শেষ দেখা হয় তখন কেমন দেখেছেন ওকে?
এমনিতে ভালোই রঙটা একটু ময়লা হয়েছে রোদে পুড়ে, একটু রোগাও হয়েছেন মনে হলো। তাছাড়া একটু যেন দুশ্চিন্তাগ্রস্তও দেখাচ্ছিলো তাকে।
দীর্ঘশ্বাস ফেললো রোয়েনা। এখানে এলেও ওর সেই দুশ্চিন্তা দূর হবে কিনা কে জানে? আইভানহো আমার ছেলেবেলার সাথী, ওর সম্পর্কে যেটুকু সংবাদ আপনি দিলেন সেজন্যে ধন্যবাদ। আপনি মনে হয় ক্লান্ত, আর আপনাকে দেরি করিয়ে দেবো না। আমি এই সামান্য উপহারটুকু দিতে চাই আপনাকে, যদি গ্রহণ করেন আন্তরিকভাবে খুশি হবো।
একটা স্বর্ণমুদ্রা এগিয়ে দিলো রোয়েনা তীর্থযাত্রীর দিকে।
টাকা পয়সার-কোনো প্রয়োজন যে আমার নেই, আপত্তির সুরে বললো অর্থযাত্রী।
আমি জানি। তবু আপনার ভবিষ্যৎ পথচার কথা ভেবে যদি গ্রহণ করেন সত্যিই বলছি আমি কৃতজ্ঞ হবো।
আর আপত্তি করলো না তীর্থযাত্রী। হাত বাড়িয়ে নিলো মুদ্রাটা। মাথা নুইয়ে অভিবাদন জানিয়ে বেরিয়ে এলো রোয়েনার ঘর থেকে। বাইরে এক ভৃত্য অপেক্ষা করছিলো ওকে ওর ঘর দেখিয়ে দেয়ার জন্যে। তার সাথে হাঁটতে লাগলো তীর্থযাত্রী।
বিরাট বাড়িটার যে অংশে চাকরবাঁকররা থাকে ভৃত্য সেখানে নিয়ে গেল তীর্থযাত্রীকে। একটা ঘর দেখিয়ে বললো, এই ঘরে থাকবেন আপনি। ভেতরে চৌক্তি আছে, ভালো ভেড়ার চামড়া আছে, আশা করি খুব একটা অসুবিধা হবে না ঘুমাতে।
আচ্ছা, ঐ ইহুদীটাকে কোন ঘরে থাকতে দেয়া হয়েছে জানো নাকি? জিজ্ঞেস করলো তীর্থযাত্রী।
আপনার পাশেরটাই। ডানদিকে।
আর গার্থের ঘর?
আপনার বা পাশেরটা।
হাতের মশালটা তীর্থযাত্রীর হাতে ধরিয়ে দিয়ে চলে গেল ভৃত্য। ঘরে ঢুকলো তীর্থযাত্রী। দরজা বন্ধ করে মশালটা এক কোণে গুঁজে রাখলো। তারপর ঘরের একমাত্র খটখটে চৌকিটায় উঠে শুয়ে পড়লো সটান। কাপড় চেপড় ছাড়ার ঝামেলা পোহালো না। গায়ের ওপর টেনে নিলো ভেড়ার চামড়া।
শোয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঘুম এলো না। নানা চিন্তায় ভারি হয়ে আছে মাথাটা। বেশ কিছুক্ষণ শুয়ে শুয়ে এপাশ ওপাশ করলো তীর্থযাত্রী। রোয়েনার কথা ভাবছে। ভাবছে নাইট টেম্পলার ব্রায়ানের কথা, স্যাক্সন সেড্রিকের কথা। ভাবতে ভাবতেই এক সময় ঘুমিয়ে পড়লো সে।
.
সূর্যোদয়ের আগ মুহূর্ত পর্যন্ত ঘুমালো তীর্থযাত্রী। তারপর উঠে প্রার্থনায় বসলো। প্রার্থনা শেষ করে নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে আইজাকের ঘরে ঢুকলো সে।
বুড়ো ইহুদী তখন দুঃস্বপ্ন দেখছেন। ঘরে ঢুকেই তীর্থযাত্রী শুনতে পেলো তার চিৎকার:
দয়া করো আমাকে! নবী আব্রাহামের নামে মিনতি করছি, দয়া করো, দয়া করো আমাকে! আমার কাছে কিছু নেই। কি দেবো তোমাদের? আমি গরীব! বিশ্বাস করো, কপর্দকশূন্য! আমাকে ছেড়ে দাও! দয়া করো! ওহ!
চিৎকার করছেন আর ঘুমের ভেতরই ছটফট করছেন আইজাক। আস্তে তার কপাল স্পর্শ করলো তীর্থযাত্রী। লাফ দিয়ে চৌকি থেকে নেমে দাঁড়ালেন বৃদ্ধ ইহুদী। বুনো আতঙ্কে বিস্তারিত দুচোখ।
ভয় পাবেন না, আইজাক, কণ্ঠে বললো তীর্থযাত্রী। আমি আপনার বন্ধু।
বন্ধু! বললেন বৃদ্ধ। এই অসময়ে এখানে!
আপনাকে সাহায্য করতে এসেছি। আপনার সামনে সমূহ বিপদ!
কিন্তু আমাকে বিপদে ফেলে কার কী লাভ?
জানি না। আমি শুধু এটুকু বলতে পারি, কাল রাতে টেম্পলার তার লোকদের যা বলেছে আমি শুনেছি।
কী বলেছে? শঙ্কিত কষ্ঠে প্রশ্ন করলেন আইজাক।
রদারউড থেকে বেরোনোর সঙ্গে সঙ্গে আপনাকে ধরে ত দ্য বোয়েফ-এর দুর্গে নিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছে টেম্পলার।
কাঁপতে কাঁপতে বসে পড়লেন আইজাক। ভয়ে কাগজের মতো শাদা হয়ে হয়ে গেছে মুখ।
ওহ্ নবী আব্রাহাম, ওহ্ ঈশ্বর! কাঁদ কাঁদ স্বরে বললেন তিনি। আমি জানতাম এমন কিছু হবে! ওরা তো একটা একটা করে আমার হাত পা খসিয়ে নেবে! বাঁচান আমাকে! দয়া করুন!
উঠুন, আইজাক, ভয়ে এমন অস্থির হয়ে পড়লে বিপদ আপনার কমবে, বরং বাড়বে। আমার কথা শুনুন, এক্ষুণি–ওরা কেউ জেগে ওঠার আগেই এ বাড়ি ছেড়ে পালাতে হবে আপনাকে।
কিন্তু কি করে পালাবো? এই অসময়ে কে আমাকে ফটক খুলে দেবে?
ও নিয়ে আপনি চিন্তা করবেন না, এখান থেকে যেন নিরাপদে বেরুতে পারেন আমি তার ব্যবস্থা করছি। এ এলাকার পথঘাট সব আমি চিনি। আপনাকে কিছুদূর এগিয়ে দিয়ে আসবো।
প্রথমে একটু ভরসা পেলেন আইজাক। তারপরই সন্দেহ দেখা দিলো তাঁর মনে। মিথ্যে কথা বলছে না তো এই তীর্থযাত্রী? টেম্পলার ব্রায়ানের মনে যা আছে এরও মনে যদি তা-ই থেকে থাকে?