কেউ খুব একটা গুরুত্ব দিলো না তার কথায়।
প্রথমেই যার নাম করতে হয় তিনি সিংহ-হৃদয় রিচার্ড স্বয়ং, বললো তীর্থযাত্রী, তার পরে আসে লর্ড লেস্টারের নাম, তিন নম্বরে স্যার টমাস মুলটন-
উনি তো স্যাক্সন, তাই না? বাধা দিয়ে বললেন সেড্রিক।
হ্যাঁ, তারপর স্যার ফোক ডয়লে-।
উনিও তো স্যাক্সন!
পঞ্চম হচ্ছেন স্যার এডুইন টার্নহ্যাম।
আরে, উনিও তত খাঁটি স্যাক্সন! সবিস্ময়ে মন্তব্য করলেন সেড্রিক। তারপর, ছ নম্বরে কে?
একটু ইতস্তত করলো তীর্থযাত্রী। ষষ্ঠজন এক তরুণ নাইট। বিখ্যাত কেউ না, পদ মর্যাদায়ও নিচু। নামটা আমি ঠিক মনে করতে পারছি না।
আমি পারছি, চিৎকার করে উঠলো টেম্পলার। সবগুলো নাম বলার পর এখন যদি বলো ভুলে গেছি, কে বিশ্বাস করবে? তবু আমি বলছি, দেখ তোমার মনে পড়ে কি না। ছনম্বর নাইটের নাম ছিলো উইলফ্রিড অভ আইভানহো। হ্যাঁ, আপনাদের সবার সামনে বলছি, আমার বিরুদ্ধেই লড়েছিলো সে। কিন্তু সেদিন ভাগ্য আমার বিপক্ষে ছিলো। প্রথমবারেই আমার বর্শা ভেঙে যায়, ঘোড়াটাও হুমড়ি খেয়ে পড়ে মাটিতে। ফলে পরাজয় স্বীকার করে নেয়া ছাড়া আর কোনো উপায় ছিলো না আমার। ও যদি এখন ইংল্যান্ডে থাকে, আর পরশুর টুর্নামেন্টে আসে, আমি তার সাথে আবার লড়বো। এবার কে জিতবে তা আমি জানি!
আইভানহো যদি ফিরে থাকে, তীর্থযাত্রী বললো, আমার মনে হয়, অন্তত একবার জয়লাভের চেষ্টা করার সুযোগ দেবে আপনাকে। আমি জামিন থাকছি।
তুমি যে জামিন থাকছে তার প্রমাণ কি? জিজ্ঞেস করলো স্যার ব্রায়ান।
ধীরে ধীরে পোশাকের ভেতর থেকে ছোট্ট একটা হাতীর দাঁতের বাক্স বের করলো তীর্থযাত্রী।
এই বাক্সটা আমি আমার জামিনের প্রমাণ হিশেবে জমা দিচ্ছি স্যার প্রায়ারের কাছে, বললো সে। প্রভু যীশুকে যে ক্রুশে বিদ্ধ করা হয়েছিলো তার ছোট্ট একটা টুকরো আছে এতে।
ব্রায়ান তাঁর গলা থেকে একটা সোনার হার খুলে ছুঁড়ে দিলো টেবিলের ওপর।
আমি যে আবার ওর সাথে লড়তে চেয়েছি তার প্রমাণ হিশেবে এই হারটা আমি জমা রাখছি প্রায়োরের কাছে, বললো সে। তারপর সরোষে যোগ করল, আইভানহো ইংল্যান্ডে ফিরেদি আমার সাথে না পড়ে তাহলে আমি ইউরোপের সমস্ত দেশে প্রচার করে দেবো, আইভানহো ভীতু কাপুরুষ।
তার বোধহয় প্রয়োজন পড়বে না, শান্ত কণ্ঠে বললো রোয়েনা। আইভানহো এখানে নেই, তবু ওর পক্ষ থেকে আমি বলছি, আইভানহো আপনাকে সুযোগ দেবে।
রোয়েনার কথা শুনে সেড্রিক প্রথমে বিস্মিত পরে বিরক্ত হলেন।
এসব বিষয়ে কথা বলা ঠিক হয়নি তোমার, রোয়েনা, বললেন তিনি। আমাদের পক্ষ থেকে কিছু যদি বলতেই হতো, আমি বলতে পারতাম। তুমি কেন?…যাক যা হওয়ার হয়েছে, এখন আর ও নিয়ে কথা বাড়িয়ে লাভ নেই।
হ্যাঁ, রাত অনেক হয়েছে, বললেন প্রয়োর অ্যায়মার। আইভানহোর সাথে স্যার ব্রায়ানের লড়াইটা যতদিন না হচ্ছে এই পবিত্র হাতির দাঁতের বাক্স আর এই সোনার হারটা আমার মঠের কোষাগারে জমা থাকবে। এবার শুতে যাওয়ার আগে আসুন লেডি রোয়েনার স্বাস্থ্য কামনা করে সবাই একপাত্র পান করি।
সবাই যার যার গ্লাসে চুমুক দিলেন। পান শেষে অতিথিরা মাথা নুইয়ে সম্মান জানালেন গৃহকর্তাকে। রোয়েনা তার দাসীদের সাথে চলে গেল।
ঘর থেকে বেরোনোর সময় সোজা দরজার দিকে না গিয়ে সামান্য ঘুরে বুড়ো আইজাকের পাশে কয়েক সেকেন্ডের জন্যে দাঁড়ালো টেম্পলার।
কি, ইহুদীর বাচ্চা, টুর্নামেন্টে যাচ্ছো? নিচু কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো সে।
প্রায় হাঁটু পর্যন্ত মাথা নুইয়ে বৃদ্ধ জবাব দিলো, জি।
নিশ্চয়ই প্রচুর টাকা এনেছে সাথে?
ভয়ার্ত চেহারা হলো আইজাকের।
না! না! কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে চেঁচিয়ে উঠলেন তিনি। একটা পেনিও নেই আমার কাছে। সত্যিই বলছি। আমার গায়ের কাপড়টা দেখছেন, এটা পর্যন্ত ধার করে আনা।
ক্রুর একটা হাসি খেলে গেল বোয়া-গিলবার্টের মুখে। আর কিছু না বলে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থাকা আরব সহচরদের দিকে এগিয়ে গেল সে। ওদের ভাষায় কিছুক্ষণ কথা বললো ওদের সাথে। কাছেই দাঁড়িয়ে ছিলো তীর্থযাত্রী। প্রতিটা কথা বুঝলো সে। কিন্তু অন্য কেউ একটা কথাও বুঝলো না, তীর্থযাত্রী যে বুঝেছে তা-ও টের পেলো না।
০৩. নিজের ঘরের দিকে যাচ্ছে তীর্থযাত্রী
নিজের ঘরের দিকে যাচ্ছে তীর্থযাত্রী। হঠাৎ রোয়েনার এক পরিচারিকা এসে থামালো ওকে।
লেডি রোয়েনা আপনার সাথে একটু কথা বলতে চান, পরিচারিকা বললো।
আমার সাথে কথা বলতে চান! বিস্ময় তীর্থযাত্রীর কণ্ঠে।
হ্যাঁ। আসুন আমার সঙ্গে।
পরিচারিকার সাথে রোয়েনার ঘরে গেল তীর্থযাত্রী। হাঁটু গেড়ে বসে অভিবাদন জানালো।
চুল আঁচড়াচ্ছিলো রোয়েনা। তিনজন পরিচারিকা পেছনে দাঁড়িয়ে সাহায্য করছে। তীর্থযাত্রীকে দেখেই ব্যস্ত হয়ে উঠে দাঁড়ালো সে।
এ কি করছেন? রোয়েনা বললো, উঠুন। আমার্কে অমন করে সম্মান দেখাতে হবে না। এই যে চেয়ারটায় বসুন। পরিচারিকাদের দিকে তাকিয়ে যোগ করলো, এলগিটা ছাড়া আর সবাই বাইরে যাও। এই পবিত্র তীর্থযাত্রীর সাথে আমি একটু একা আলাপ করতে চাই।
একে একে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল তিন দাসী।
তীর্থযাত্রী, শুরু করলো রোয়েনা, একটু আগে খাওয়ার ঘরে আপনি উইলফ্রিড অভ আইভানহোর কথা বলছিলেন। আমার অনুরোধ, দয়া করে বলুন, কবে আপনি ওকে শেষ দেখেছেন? ভালো ছিলো তো?