- বইয়ের নামঃ আইভানহো
- লেখকের নামঃ স্যার ওয়ালটার স্কট
- সিরিজঃ কিশোর ক্লাসিক সিরিজ
- প্রকাশনাঃ সেবা প্রকাশনী বই
- বিভাগসমূহঃ কল্পকাহিনী, অ্যাডভেঞ্চার, ইতিহাস, রোম্যান্টিক গল্পের বই
আইভানহো
০১. ইংল্যান্ডের উত্তরাঞ্চল
স্যার ওয়ালটার স্কটের জন্ম ১৭৭১ সালে, স্কটল্যান্ডের এডিনবরায়। মাত্র দেড় বছর বয়সে তিনি হাড়ের অসুখে আক্রান্ত হন, পরিণামে চিরদিনের জন্যে একটা পা তাঁর খোঁড়া হয়ে যায়। পনের বছর বয়স হওয়ার আগেই পাঠ্যতালিকার বাইরে প্রচুর বই তিনি পড়ে ফেলেন এবং ইতিহাস ও স্কটল্যান্ডে প্রচলিত গল্প-গাথার ব্যাপারে উৎসাহী হয়ে ওঠেন। একুশ বছর বয়েসে তিনি এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। বাবাকে খুশি করার জন্যে এখানে তিনি আইন শাস্ত্র নিয়ে লেখাপড়া করেন। অবসর সময়ে তিনি ইতিহাস পড়তেন বা স্কটিশ লোক-কাহিনী সগ্রহ করতেন।
১৭৯৭ সালে জনৈক ফরাশি উদ্বাস্তুর কন্যাকে বিয়ে করেন ওয়ালটার স্কট। মেয়েটির নাম শার্লট শারপেনটিয়ের। ১৭৯৯ সালে সেলার্কশায়ারের শেরিফ নিযুক্ত হন স্কট।
১৮০৫ সালে প্রথম উপন্যাস লেখায় হাত দেন ওয়ালটার স্কট। নাম ওয়েভারলি। কিছুদূর লেখার পর উপন্যাসটি ফেলে রাখেন তিনি। শেষ করেন প্রায় দশ বছর পর ১৮১৪ সালে। সেই বছরই বইটি প্রকাশিত হয়, এবং অভাবনীয় জনপ্রিয়তা লাভ করে।
১৮১৮ সালে স্যার উপাধিতে ভূষিত করা হয় ওয়ালটার কটকে। ১৮৩২ সালে মারা যান এই অমর ঔপন্যাসিক।
.
ভূমিকা
এ কাহিনীর শুরু ইংল্যান্ডে, আজ থেকে প্রায় সাড়ে সাতশো বছর আগে, ত্রয়োদশ শতাব্দীর শুরুতে। নরম্যান রাজা সিংহ-হৃদয় রিচার্ড তখন ইংল্যান্ডের সিংহাসনে। যখন এ কাহিনীর যবনিকা উঠছে রিচার্ড তখন দেশের বাইরে, মুসলমানদের হাত থেকে পবিত্র নগরী জেরুজালেম উদ্ধারের জন্যে যুদ্ধ করছেন প্যালেস্টাইনে। তার হয়ে ইংল্যান্ড শাসন করছেন তার ভাই জন। ইংল্যান্ডের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসাধারণ স্যাক্সন গোত্রের লোক। তারা মোটেই খুশি নয় জনের শাসনে। এর প্রধান কারণ স্যাক্সনদের প্রতি তার নির্দয় আচরণ।
আরেকটা কারণে জনসাধারণ বিক্ষুব্ধ। প্রায় দুশো বছর আগে ১০৬৬ সালে ইংল্যান্ড দখল করে নরম্যানরা। ফ্রান্স থেকে আসা এই জাতি খুব শিগগিরই রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতায় দেশের সর্বস্তরে স্যাক্সনদের চেয়ে শক্তিশালী হয়ে ওঠে। ইংল্যান্ডের বেশির ভাগ বড় সরকারি পদ, জমিদারী দখল করে বসে তারা। এবং স্থানীয় স্যাক্সনদের নিচু শ্রেণীর মানুষ হিশেবে গণ্য করতে থাকে। এই কারণে স্যাক্সন ও নরম্যানদের ভেতর অবিশ্বাস এবং রেষারেষি লেগেই থাকতো। জনের আচরণে এই অবিশ্বাস আর বিক্ষোভ শুধু বেড়েই ওঠেনি, রীতিমতো রাজ বিদ্রোহের রূপ নিতে চলেছে।
এই যখন ইংল্যান্ডের অবস্থা তখনই শুরু হচ্ছে আমাদের কাহিনী।
.
০১.
ইংল্যান্ডের উত্তরাঞ্চল।
বিশাল শেরউড বনভূমির ওপর ধীরে ধীরে নেমে আসছে সন্ধ্যার আঁধার। গাছপালা যে-সব জায়গায় ঘন সে-সব জায়গায় এর ভেতরই যেন রাত হয়ে গেছে। বনের মাঝামাঝি স্থানে একটুখানি ফাঁকা জায়গা। ঘাসে ছাওয়া। কোনো গাছ নেই সেখানে। চারপাশে বড় বড় ওকের ঝোপ। এক ধারে ছোট একটা টিলা। তার ওপর ছড়িয়ে আছে ছোট বড় নানা আকারের পাথর। হয়তো প্রাগৈতিহাসিক কোনো কালে বর্বর বনবাসীরা তাদের দেবতার উদ্দেশ্য উৎসর্গ করেছিলো ওগুলো। টিলার মাথায় পাথরগুলোর গায়ে এখনও খেলা করছে দিনশেষের সোনালি আলো। ফাঁকা জায়গাটার ওপাশে দূরে জমতে শুরু করেছে ঘন কালো মেঘ। মাঝে মাঝে ভেসে আসছে বজ্রগর্জনের অস্পষ্ট আওয়াজ।
ফাঁকা জায়গার এক প্রান্তে এক পাল শুয়োর চরে বেড়াচ্ছে। কাছেই দুজন লোক। একজন দাঁড়িয়ে, একজন বসে। যে লোকটা দাঁড়িয়ে তার বয়েস বসে থাকা লোকটির চেয়ে একটু বেশি। উদ্বিগ্ন চোখে সে তাকিয়ে আছে ক্রমশ আঁধার হয়ে আসা আকাশের দিকে। আর যে বসে আছে সে গভীর চিন্তায় মগ্ন, যেন বিশ্বরহস্যের সমাধান আজই তাকে করতে হবে।
দাঁড়িয়ে থাকা লোকটার চেহারায় অদ্ভুত এক বন্য ভাব। সাদাসিধে পোশাক পরনে। হাঁটু পর্যন্ত লম্বা ভেড়ার চামড়ার কোট, কোমরে বাঁধা চওড়া চামড়ার ফিতে; পায়ে চটি, তা-ও চামড়ার ফিতে দিয়ে আটকানো। কোমরের ফিতের এক দিকে ঝুলছে একটা শিঙা, অন্যদিকে গোঁজা বড় একটা দুধার ছোরা। মাথায় টুপি নেই। চুলগুলো এলোমেলো। গালভর্তি চাপ দাড়ি। সম্ভবত চুলের তলনায় দাড়িই লম্বা বেশি। লোকটার গলায় বাঁধা একটা পেতলের আটা। তাতে ছোট ছোট অক্ষরে খোদাই করা: বিউলফ-এর পুত্র গাৰ্থ, রদারউডের জমিদার সেড্রিক-এর জন্মক্রীতদাস।
জমিদারের শুয়োরের পাল দেখাশোনা করে সে।
কম বয়েসী লোকটার চেহারা, পোশাক-আশাক একটু অন্য ধরনের। গার্থের চয়ে বছর দশেকের ছোট সে। মুখে গাম্ভীর্যের মুখোশ আঁটা। চেহারা দেখে কারো পক্ষে আন্দাজ করা সম্ভব নয় তোক হাসানোই তার কাজ। পরনে রঙচঙে রেশমী কোর্ট; মাথায় টুপি, দেখতে মোরগের ঝুঁটির মতো, ছোট ছোট ঘণ্টা বাধা তার সাথে। লোকটা মাথা নাড়লেই টুং-টাং শব্দে বেজে ওঠে সেগুলো। মাথা স্থির করে বসে থাকা তার স্বভাবে নেই, তাই টুং-টাং আওয়াজেরও বিরাম নেই। দুই হাতে তার দুটো রুপোর বালা। পায়ে গার্থের মতোই চামড়ার চটি; মোজা, একটার রঙ লাল, অন্যটা হলুদ। গার্থের মতো এ লোকটিরও গলায় একটা পেতলের আঙটা। তাতে ছোট ছোট অক্ষরে খোদাই করা: উইটলেস-এর পুত্র ওয়াম্বা, রদারউডের জমিদার সেড্রিক-এর জন্মক্রীতদাস।