বেচতে পারার আগেই চুরি গেলে খুব দুঃখজনক হবে ব্যাপারটা, বলল ডাক্তার। ঘরের কোণে, মেঝের দিকে ঝট করে দৃষ্টি চলে গেল কিনোর, নজর এড়াল না ডাক্তারের।
ডাক্তার আর পড়শীর বিদায় নিলে পর, চুলোর পাশে বসে কান পেতে রাতের গুঞ্জন শুনতে লাগল কিনো। ছোট ছোট ঢেউ ভাঙছে সৈকতে, কোথায় যেন হাঁক-ডাক ছাড়ছে কুকুরের পাল। ছাদের ফোকর গলে বাতাস চলাচল করছে, কানে আসে প্রতিবেশীদের কথাবার্তার টুকরো শব্দ। ডুবুরিরা সারা রাত একটানা ঘুমোয় না। মাঝে মাঝেই ঘুম ভেঙে, খানিক গল্প-গুজব করে, তারপর আবার ঘুম দেয়।
একটু পরে উঠে পড়ে দরজার কাছে এল কিনো। রাতের বাতাসের ঘ্রাণ নিয়ে, কান খাড়া করল কেউ আসে কিনা শোনার জন্যে। আঁধারে দৃষ্টি চলে গেল। মনে মনে ভয় পাচ্ছে সে। কেন জানি মনে হচ্ছে, মুক্তোটা চুরি করতে লোক আসতে পারে আজ রাতে। ঘরের প্রান্তে, গুপ্তস্থানটার কাছে এসে দাঁড়াল কিনা। রত্নটা তুলে নিয়ে মাদুরের কাছে এল। মেঝেতে আরেকটা খুদে গর্ত করল ও। গর্তের ভেতর মুক্তোটা রেখে ওটাকে ঢেকে দিল। অবারও।
হুয়ানা, চুলোর পাশে বসে ছিল, সাবধানী দৃষ্টিতে লক্ষ্য করছে কিনোকে।
কাকে ভয় পাচ্ছ তুমি? জানতে চাইল।
সবাইকে, জবাব দিল কিনো।
একটু পরে, মাদুরে গা এলিয়ে দিল স্বামী-স্ত্রী। সে রাতে দোলনায় শোয়াল না হুয়ানা কয়োটিটোকে। বুকের ওপর উপুড় করে ফেলে বাচ্চার মুখ ঢেকে রাখল শাল দিয়ে। নিভন্ত আগুনটা এক সময় ধীরে ধীরে মরে গেল।
ঘুমের মধ্যেও মাথায় চিন্তা পাক খাচ্ছে কিনোর। স্বপ্ন দেখছে কয়োটিটো পড়তে পারে। আরও দেখল এই বাড়ির সমান মস্ত এক বই নিয়ে বসেছে তার ছেলে। বইটার অক্ষরগুলো একেকটা ইয়া বড় বড় কুকুরের সমান। স্বপ্ন যখন ফুরাল আঁধার তখনও কাটেনি। মাদুরে ছটফট করছে কিনো। ও নড়াচড়া করতে, হুয়ানার চোখ খুলে গেল। কিনো এবার সজাগ হয়ে আঁধারে কান পেতে শুয়ে রইল।
ঘরের ওই কোণটা থেকে মৃদু একটা শব্দ হলো না? কে যেন নড়াচড়া করছে আওয়াজ পেল কিনো। শ্বাস বন্ধ করে শুনতে চেষ্টা করল ও। অনাহুত আগন্তুকটিও দম আটকে রয়েছে, জানা আছে ওর। কিনোর একবার মনে হলো সে স্বপ্ন দেখছে না তো? কিন্তু হুয়ানার হাত ওর গা স্পর্শ করতে উৎকর্ণ হলো আবারও। শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ কানে এল ওর। শুকনো মাটি খামচাচ্ছে কার যেন আঙুল স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে।
হঠাৎই মাথায় রাগ উঠে গেল কিনোর। ছোরায় আস্তে করে হাতটা চলে গেল ওর। এবার রাগী বেড়ালের মত শব্দ লক্ষ্য করে ঝাঁপিয়ে পড়ল সে, হাতে উদ্যত ছোরা। কার যেন জামার ছোঁয়া লাগতে সবেগে ছোরা চালিয়ে দিল। তবে কারও গায়ে লাগেনি। আবারও ঘাই মারতে জামা চিরে ছোরা চলে গেছে টের পেল। মাথায় এবার প্রতিপক্ষের বাড়ি পড়ল কিনোর। দপ করে আগুন ধরে গেল যেন জায়গাটায়। ওই যে, লোকটা ছুটে পালাচ্ছে। পদশব্দ মিলিয়ে যেতে ফের নিস্তব্ধ চারদিক। উষ্ণ রক্ত গড়িয়ে নামছে মুখ বেয়ে, হুয়ানা ডাকছে ওকে খেয়াল হলো কিনোর।
কিনো! কিনো! আকুল স্বরে ডাকছে হুয়ানা। ভীষণ ভয় পেয়েছে সে।
আমি ঠিক আছি, বলল কিনো। ব্যাটা পালিয়েছে।
আস্তে আস্তে শয্যার কাছে ফিরে এল কিনো। চুলোয় এরমধ্যেই অাগুন ধরাতে ব্যস্ত হুয়ানী। একটুকরো জ্বলন্ত অঙ্গার আর কিছু ছোটখাট খড়ি খুঁজে পেয়েছে। ফুঁ দিয়ে দিয়ে আগুনটা উস্কে দিতে লাগল ও। শীঘ্রিই অল্প একটুখানি আলো ঘরের ভেতর নাচতে লাগল। হুয়ানা এবার একটা মোমবাতি নিয়ে, অগ্নিশিখা থেকে ওটা ধরিয়ে, চুলোর কাছে বসিয়ে দিল। ত্ৰস্ত হাতে কাজ সারছে হুয়ানা, আর তারই ফাঁকে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। শালের খুঁটি পানিতে ভিজিয়ে স্বামীর মাথা থেকে রক্ত মুছে দিল।
কিছু হয়নি, বলল কিনো, কিন্তু কণ্ঠস্বর কঠোর আর শীতল ওর। হঠাৎ ডাক ছেড়ে কেঁদে উঠল হুয়ানা।
ওগো, মুক্তাটা অলক্ষুণে! চেঁচিয়ে উঠল। ওটা আমাদের সর্বনাশ করে ছাড়বে। তুমি ওটা ফেলে দাও! পাথর দিয়ে, এসো, ওটাকে ভেঙে চুরমার করে দিই। মুক্তোটা সাগরে ছুঁড়ে ফেলে দাও তুমি।
আগুনের ম্লান আলোয়, হুয়ানার ঠোঁট আর চোখজোড়া ভীত-সন্ত্রস্ত দেখাচ্ছে। কিন্তু কিনোর মুখের চেহারায় এখন অদ্ভুত এক দৃঢ়তা।
এরকম সুযোগ আর আসবে না, বলল ও। আমাদের ছেলেকে ইসকুলে পাঠাতে হবে না? আমি চাই না ও আমার মত বেহদ্দ গরীব থাকুক। জীবনে ওকে অনেক উন্নতি করতে হবে।
হুয়ান আবারও চিৎকার করে উঠল।
মুক্তাটা আমাদের ধ্বংস করে দেবে। আমাদের বাচ্চাটাও রেহাই পাবে না।
চুপ করো তো! ধমক দিল কিনো। কাল সকালেই তো মুক্তাটা বেচে দেব। তখন আর ভয় কিসের? এবার একটু শান্ত হও, বউ।
খুদে আগুনটার দিকে যখন চাইল, কিনোর চোখের কালো মণি দুটো ধকধক করে জ্বলছে। হাতে তখনও ছুরিটা ধরা ওর। ছুরিটা চোখের কাছে তুলে ধরে ওটার উদ্দেশে চাইল সে। হালকা রক্তের একটা দাগ ধরা পড়ল ওর চোখে। মাটিতে ঘষে ঘষে ফলাটা পরিষ্কার করল ও।
ভোরের বাতাস বইছে গাছ-গাছালির ফাঁকে ফাঁকে, সাগরের বুকে। বেলাভূমিতে আছড়ে পড়ছে খুদে খুদে উর্মি। কিনো তার মাদুরটা টেনে মুক্তোটা তুলে নিল গর্ত থেকে। রত্নটা হাতে ধরে রেখে দীর্ঘক্ষণ একদৃষ্টে চেয়ে রইল। মুক্তোটার শোভা আবারও স্বপ্নাবিষ্ট করে তুলল ওকে। কী অপরূপ জিনিসটা, আহা। ভবিষ্যতে সুখ কেনা যাবে এটা দিয়ে। দীপ্তিমান মুক্তোটা সবধরনের রোগ-বালাই আর বিপদ-আপদ ঠেকিয়ে রাখবে। কিনোর পরিবারকে আর কোনদিন খিদের জ্বালা সইতে হবে না।