ঘন্টা খানেকের মধ্যে বিষক্রিয়া শুরু হবে, ডাক্তার বলল। ওষুধটা হয়তো এ যাত্রা বাঁচিয়ে দিতে পারে বাচ্চাটাকে। আমি এক ঘণ্টার মধ্যে আবার আসছি। ভাগ্যিস সময় মত এসেছিলাম।
ডাক্তার গভীর করে শ্বাস টেনে ঘরত্যাগ করল। টর্চ হাতে অনুসরণ করল তার ভৃত্য।
কয়েটিটোকে শালের নিচে গুঁজে দিল হুয়ানা। বাচ্চাটার জন্য উদ্বেগ আর আতঙ্ক অনুভব করছে ও। কিনো এগিয়ে এল। শাল তুলে বাচ্চাকে দেখল। চোখের পাতার নিচেটা দেখার জন্যে হাত বাড়াল কিনো। এবার খেয়াল হলো মুক্তোটা তখনও হাতে ওর। দেয়াল লাগোয়া এক বাক্স থেকে এক টুকরো কাপড় বের করল ও, মুক্তোটা মুড়িয়ে রাখল ওতে। এরপর ছোট্ট বাসাটার এক কোণে গিয়ে, মেঝেতে আঙুল দিয়ে খুদে এক গর্ত তৈরি করল। মুক্তোটা ভেতরে রেখে, ধুলো-বালি দিয়ে গর্তের মুখ বুজিয়ে দিল। চুলোর কাছে বসে থাকা স্ত্রীর দিকে এগিয়ে গেল এবার।
ওদিকে বাড়িতে, চেয়ারে আরাম করে বসে, হাতঘড়িতে নজর বুলাল ডাক্তার। কাজের লোকটা চকোলেট আর কেক নিয়ে এল। খাবারের দিকে একবার মাত্র দৃষ্টি দিল ডাক্তার, খিদে নেই তার।
পড়শীরা যার যার বাসায়, কিনোর মুক্তোর আলোচনায় ব্যস্ত। একে অপরকে মুক্তোর আকার দেখাচ্ছে তারা। পরস্পরকে বলছে রত্নটার অনিন্দ্যসুন্দর সৌন্দর্যের কথা। পড়শীরা আগ্রহ ভরে অপেক্ষা করছে, মুক্তোটা কিনো আর হুয়ানাকে কতখানি বদলে দেয় নিজের চোখে দেখবে। প্রতিবেশীরা ভাল করেই জানে, মুক্তোর লোভেই ডাক্তারটা এসেছে কিনোর বাসায়।
বড্ড গরম পড়েছে আজ রাতে। লিকলিকে কুকুরটা কিনোর দরজায় এসে ভেতরে উঁকি দিল। কিনো ওটার দিকে চাইতে গা ঝাড়া দিল। কিনে চোখ ফেরাতে, কুকুরটা শুয়ে পড়ল মাটিতে। ঘরের মধ্যে ঢুকল না জানোয়ারটা, কিনো খাবার খাচ্ছে লক্ষ্য করছে।
খাওয়ার পর্ব সারা হলে, হুয়ানা হঠাৎ কথা বলে উঠল।
কিনো, বলল সে।
হুয়ানার দিকে চাইল কিনো, তারপর উঠে দাঁড়িয়ে ত্বরিত ওর কাছে চলে এল। হুয়ানা আতঙ্কিত, লক্ষ্য করল ও। নিচের দিকে দৃষ্টি স্থির রেখে দাঁড়িয়ে রইল কিনো। আলো কম, কিছু দেখতে পেল না। লাথি মেরে আগুনে খড়ি ফেলে আগুন উস্কে দিল কিনো। পরমুহূর্তে বাচ্চার মুখটা চোখে পড়ল ওর। মুখ আর ঠোঁটজোড়া লাল হয়ে গেছে কয়েটিটোর। হঠাৎ, কয়োটিটোর গলা আর পেট নড়ে উঠল। বোঝা যাচ্ছে ভয়ানক অসুস্থ বাচ্চাটা।
ডাক্তার জানত ও অসুস্থ হয়ে পড়বে, বলল কিনো।
ওষুধের কথা মনে পড়ল ওর। কোন সন্দেহ নেই, ডাক্তারটাই কয়োটিটোকে অসুস্থ বানিয়েছে। এপাশ-ওপশি দুলে একটা গান ধরল হুয়ানা। ওর বিশ্বাস, গানটা বিপদ-আপদ দূরে সরিয়ে রাখবে। মার কোলে দুলছে কয়েটিটো, নাভিশ্বাস উঠে গেছে তার।
চকোলেট আর কেকগুলো সাবাড় করল ডাক্তার। আঙুল থেকে কেকের গুড়ো ঝেড়ে ঘড়ি দেখল। এবার উঠে দাঁড়িয়ে ব্যাগটা তুলে নিল।
বাচ্চাটার অসুস্থতার খবর ঘরে ঘরে জানাজানি হয়ে গেছে। অসুখবিসুখ, খিদের জ্বালার মতই, গরীব মানুষের চিরশত্রু।
কেউ কেউ মৃদু সুরে বলল, সৌভাগ্যের সঙ্গে সঙ্গে খারাপ বন্ধু-বান্ধবও জুটে পড়ে। সবাই মাথা নাড়ল এবং রওনা দিল কিনোর বাসার উদ্দেশে। রাতের আঁধারে দ্রুত পা চালিয়ে, আবারও কিনোর বাড়িতে এসে হাজির হলো পড়শীরা। সবার মুখে এক কথা, সুখ আর দুঃখ হাত ধরাধরি করে চলে। বৃদ্ধা মহিলারা হুয়ানার পাশে বসে তাকে সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করছে।
সবই আল্লার ইচ্ছা, বলছে তারা।
চাকরটাকে পেছনে নিয়ে, ডাক্তার এসে ঘরে ঢুকল। বৃদ্ধা মহিলার সঙ্গে সঙ্গে পিছু হটে গেল। ডাক্তার এবার বাচ্চাটাকে কোলে তুলে নিল। গভীর মনোযোগে কয়েটিটোকে পরীক্ষা করে রোগীর মাথায় হাত রাখল ডাক্তার।
বিষটা এখনও এখানে আছে, বলল লোকটা। তবে আমি মনে হয় নামিয়ে দিতে পারব। সাধ্যমত চেষ্টা করব আমি।
কাপে করে খানিকটা পানি আনতে বলল সে। সামান্য ওষুধ ওতে গুলে বাচ্চাটার মুখে ঢেলে দিল। কয়েটিটো কেশে উঠে কান্না জুড়ে দিল। ভীতিমাখা চোখে চেয়ে রয়েছে কাতর মা। কাজের ফাঁকে অল্প স্বল্প কথাবার্তাও বলল ডাক্তার।
এই রোগের চিকিৎসা আগেও করেছি আমি, বলল সে।
ধীরে ধীরে, ডাক্তারের বাহুতে ছটফটানি বন্ধ করল বাচ্চাটা। গভীর করে শ্বাস টেনে ঘুমিয়ে পড়ল ক্লান্ত, ছোট্ট রোগী। মার কোলে বাচ্চাকে ফিরিয়ে দিল ডাক্তার।
ও এখন ভাল হয়ে যাবে, বলল লোকটা। আমার চিকিৎসায় কাজ হয়েছে।
ব্যাগ বন্ধ করে ডাক্তার কথা বলল অাবারও।
ফীটা কখন দিতে পারবে?
মুক্তা বেচে নিই, তারপর, জবাব দিল কিনো।
ও, মুক্তো আছে বুঝি তোমার কাছে? তা কেমন সেটা, কি জাতের? ডাক্তারের সে কি উৎসাহ।
এবার সবকজন প্রতিবেশী একসাথে কথা বলে উঠল।
দুনিয়ার সেরা মুক্তাটা খুঁজে পেয়েছে ও, জানাল ওরা, সবকটা আঙুল গোল করে আকারটা দেখাল।
কিনো বেজায় ধনী হয়ে যাবে, বলল পড়শীরা। কেউ কখনও ওরকম মুক্তা চোখে দেখেনি।
তাই নাকি, জানতাম না তো? সাধু সাজল ডাক্তার। নিরাপদ জায়গায় রেখেছ তো জিনিসটা? চাইলে আমার কাছে আমানত রাখতে পারো।
আধ বোজা চোখে ডাক্তারের দিকে তাকাল কিনো।
ওটা নিরাপদ জায়গাতেই আছে, বলল। কাল ওটা বেচে আপনার ফী মিটিয়ে দেব।
কিনোর চোখের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করল ডাক্তার। মুক্তোটা এবাড়িরই কোথাও না কোথাও লুকানো আছে জানে সে। তার মনে আশা, কোথায় লুকিয়েছে সেদিকে একবার না একবার চাইবেই কিনো।