তোমাদের মাথায় প্রথমেই ভাল ভাল চিন্তা এসেছে জেনে খুব খুশি হলাম, বললেন পাদ্রী। খোদা তোমাদের মঙ্গল করুন, বাছারা।
পাদ্রী ঘুরে দাঁড়ালেন, এবং লোকজন তাঁকে পথ ছেড়ে দিল। কিনোর হাত শক্ত করে চেপে ধরল মুক্তোটা। চারধারে দৃষ্টি বুলিয়ে নিল ও। আতঙ্কবোধটা ক্রমেই আবারও গ্রাস করছে ওকে।
পড়শীরা বিদায় নিলে চুলোর পাশে বসল হুয়ানা। খুদে অগ্নিস্ফুলিঙ্গের ওপর সেদ্ধ বিনের পাত্রটা চাপাল ও। কিনো দরজা অবধি হেঁটে গিয়ে উঁকি দিল বাইরে। প্রতিবেশীদের চুলোয় রান্না চড়েছে ঘ্রাণ পাওয়া যাচ্ছে। আকাশে আজ তারার মেলা। গা হিম হয়ে এল ওর, নাক ঢেকে নিল কম্বলে।
রোগাটে কুকুরটা ওর কাছে এসে গা ঝাড়া দিল। কিনো চোখ নামাল, কিন্তু আসলে ও কুকুরটাকে দেখছে না। বড্ডো নিঃসঙ্গ মনে হচ্ছে ওর নিজেকে, মোটেও নিরাপদ বোধ করছে না সে। নিশাচর কীট-পতঙ্গ কী এক অশুভ তান ধরেছে মনে হলো ওর। শিউরে উঠল কিনো। কম্বলটা ভালমত টেনে দিল নাক পর্যন্ত। মুক্তোটা তখনও হাতে ধরা ওর। জিনিসটা উষ্ণ আর মসৃণ ঠেকল ওর তালুতে।
পেছনে হুয়ানার অস্তিত্ব টের পাচ্ছে কিনো। কেক বানাচ্ছে ও আগুনের কাছে বসে। কমুহূর্তের জন্যে নিরাপত্তার অনুভূতি হলো কিনোর। এরপর আবার ভয়টা জাঁকিয়ে বসল মনের মধ্যে। ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা করতে সাহস পাচ্ছে না কিনো। পরিকল্পনা করা বিপজ্জনক, জানা আছে তার। বেশি বেশি পরিকল্পনা করে যে, তার কপালে খারাবি থাকে।
মুক্তো বেচে হাতে টাকা পেতে চায় কিনো। স্কুলে পাঠাতে চায় ছেলেকে। কত পরিকল্পনাই না আছে তার মাথার মধ্যে। কিন্তু সে সঙ্গে বিপদের আশঙ্কাও কি নেই? কিন্তু টাকাটা যে ওর ভীষণ দরকার। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থেকে, রাতের আঁধারের দিকে একদৃষ্টে চেয়ে রইল ও।
০৫. কিনো দরজায় দাঁড়িয়ে
কিনো দরজায় দাঁড়িয়ে, লক্ষ্য করল দুজন লোক এদিকেই আসছে। একজনের হাতে একটা টর্চ, মাটি আর লোকটির দুপাআলোকিত ওটার আলোয়। কিনোর কাঠের বেড়ার ফাঁক গলে ঢুকে দরজার কাছে চলে এল ওরা। কিনো এবার দেখতে পেল দুজনের একজন হচ্ছে সেই ডাক্তার আর অপরজন তার ভৃত্য।
তুমি সকালে যখন গেছিলে আমি তখন বাসায় ছিলাম না, ফ্যাকাসে হেসে বলল ডাক্তার। তোমার বাচ্চার খবর শুনে আর দেরি করিনি, ছুটতে ছুটতে চলে এসেছি।
কিনো দরজায় ঠায় দাঁড়িয়ে, ঘৃণায় জ্বলছে দুচোখ ওর। আবারও ভয় লেগে উঠল কিনোর। ভয় পাওয়ার কারণ, ডাক্তারের গোত্র শত শত বছর ধরে অত্যাচার-নিপীড়ন চালিয়েছে ওর পূর্বপুরুষদের ওপর।
আমার বাচ্চা সেরে গেছে প্রায়, ফট করে বলে বসল কিনো।
মুচকি হাসল ডাক্তার, হাসিটা যদিও তার চোখ স্পর্শ করল না।
মাঝে মাঝে হয় কি, বলল লোকটা, বিছের কামড় খাওয়া বাচ্চাকে দেখলে মনে হয় বাহ, সেরে গেছে বুঝি, কিন্তু তারপর হঠাৎ করে…
ঠোঁটে মৃদু শব্দ করল ডাক্তার, দেখাল মৃত্যু কত অতর্কিতে হানা দিতে পারে।
কখনও কখনও, কথার খেই ধরে ডাক্তার, পা শুকিয়ে যায়, চোখ অন্ধ হয়ে যায়, পিঠ বাঁকা হয়ে যায়। আমি ডাক্তার, আমি তো জানি, বন্ধু, বিছের কামড় কী জিনিস। চিন্তা কোরো না, আমি তোমার বাচ্চাকে সারিয়ে দেব।
ভয়টা আরও জেঁকে বসল কিনোর বুকে। বিছের কামড় সম্পর্কে তার কোন অভিজ্ঞতা নেই। ডাক্তার লোকটা কত শত বই পড়েছে। ও হয়তো ঠিকই বলছে। নিজের ওপর তো বটেই, ডাক্তারের ওপরও রেগে উঠছে কিনো। কেন বই পড়তে শেখেনি সেজন্য নিজের প্রতি রাগ। আর ডাক্তার ব্যাটা বেশি জানে কেন, সেজন্যে তার ওপর চাপা ক্ষোভ।
ইতিকর্তব্য ঠিক করতে পারছে না কিনো। ও স্থিরনিশ্চিত ডাক্তারটা মিছে কথা বলছে। কিন্তু ছেলের ক্ষতি হয়ে যেতে পারে এমন কিছু তো করতে পারে না সে বাপ হয়ে। পিছু হটে লোক দুটোকে তার ছোট্ট বাড়িটার ভেতর ঢুকতে দিল।
হুয়ানা ডাক্তারকে দেখে সিধে উঠে দাঁড়াল। শাল দিয়ে মুখ ঢেকে দিল বাচ্চাটার। ডাক্তার ওর সামনে গিয়ে দুহাত বাড়িয়ে দিতে, বাচ্চাকে বুকের সঙ্গে আঁকড়ে ধরল ভীতা মা। কিনোর দিকে চাইল হুয়ান। আগুনের ছায়া নেচে বেড়াচ্ছে স্বামীর মুখের ওপর। কিনো মাথা নাড়তে ডাক্তারের হাতে বাচ্চাকে ছাড়ল মা।
টর্চটা ধরো, বলল ডাক্তার। চাকর লোকটা টর্চ উচিয়ে ধরতে রোগীর কাঁধের ক্ষতটা পরখ করে দেখল ডাক্তার। এক মুহূর্ত কি যেন ভেবে, কয়োটিটোর চোখের পাতা টেনে চোখ নিরীখ করল। বাচ্চাটা তার হাতে ছটফট করে উঠতে মাথা ঝাঁকাল ডাক্তার।
এমনটাই ভেবেছিলাম, বলল ডাক্তার। বিষ ভেতরে চলে গেছে। এর অবস্থা খারাপ হতে থাকবে। এসো, দেখে যাও!
বাচ্চাটার চোখে চোখ রাখল ডাক্তার। কিনো লক্ষ্য করল চোখটা ঈষৎ নীলচে। এটাই কয়েটিটোর চোখের স্বাভাবিক রং কিনা জানা নেই কিনোর। ডাক্তারকে বিশ্বাস করবে কি না বুঝে উঠতে পারছে না সে। এখন আর কিছু করারও তো নেই।
ব্যাগ থেকে বড়ি ভর্তি পিচ্চি এক শিশি বের করল ডাক্তার। এবার কয়োটিটোকে কোলে নিয়ে ওর ঠোঁটজোড়া চেপে ধরে রইল, বাচ্চাটা যতক্ষণ না মুখ খোলে। মুখ খুলতেই, ডাক্তারের গোদা গোদা দুটো আঙুল, রোগীর জিভের যতটা গভীরে পারে ফেলে দিল একটা বড়ি। কয়েটিটো এখন আর উগরে দিতে পারবে না ওষুধ। ডাক্তার এরপর জগ থেকে খানিকটা পানি ঢেলে দিল কয়েটিটোর মুখের ভেতর। বাচ্চাটার চোখ আরেকবার পরীক্ষা করে ওকে এবার মার কোলে ফিরিয়ে দিল।