আমরা গির্জায় যাব-বিয়ে করতে, বলল কিনো।
মুক্তোর মধ্যে ফুটে উঠেছে সুবেশ কিনো পরিবারের ছবি। বিয়ের কল্পনা করছে কিনো। হুয়ানার পরনে নয়া শাল আর নয়া স্কার্ট। লম্বা ঝুলের স্কার্টের নিচ দিয়ে পায়ে জুতোও দেখা যাচ্ছে হুয়ানার। কিনোর গায়ে সাদা রঙের নতুন পোশাক, আর হাতে নতুন হ্যাট। কয়োটিটোর পায়েও জুতো। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানী করা নীলরঙা নাবিক স্যুট আর ছোট্ট এক ক্যাপ পরেছে ওর বাচ্চা। ঝকমকে মুক্তোটার মধ্যে এ সব কিছুই পরিস্কার লক্ষ্য করছে কিনা।
নতুন কাপড় কিনব আমিরা, স্বপ্নাচ্ছন্নের মত বলল সে।
আরও কি কি কিনবে তার স্বপ্নজাল বুনতে লাগল এবার কিনো। পয়সা হয়েছে যখন, একটা রাইফেল কিনবে। রাইফেল হাতে ওই তো মুক্তোর গায়ে ছবি দেখা যাচ্ছে কিনোর। বড় সুখকর সব ছবি ফুটে উঠছে কিনোর মনের পর্দায়।
একটা রাইফেল কিনতে পারি, মৃদু সুরে বলল কিনো। মানে কিনব আরকি।
প্রতিবেশীরা, নীরবে কিনোর কথা শুনছিল, মাথা নাড়ল। পেছন দিকে বসে থাকা এক লোক নরম সুরে আওড়াল, রাইফেল। কিনো রাইফেল কিনবে।
কিনোর দিকে চাইল হুয়ানা। চোখ বিস্ফোরিত ওর। কিনোর মধ্যে কি যেন এক আশ্চর্য ক্ষমতা এসে গেছে, অনুভব করছে ও।
মুক্তোটার দিকে চেয়ে থেকে, আরেকটি স্বপ্ন দেখতে ব্যস্ত এখন কিনো। স্কুলে খুদে এক ডেস্কের পেছনে বসে আছে ওর আদরের কয়েটিটো সোনামণি। একবার পথে যেতে যেতে, স্কুলের খোলা দরজার ফাঁক দিয়ে একটা ডেস্ক দেখেছিল কিনো। কয়োটিটোর গায়ে জ্যাকেট, ধবধবে সাদা কলার আর সিল্কের মোটাসোটা টাই। মস্ত বড় এক কাগজে কি সব যেন লিখছে ও। পড়শীদের দিকে তাকাল কিনে।
আমার ছেলে ইসকুলে যাবে, বলল সে, এবং নীরব হয়ে গেল প্রতিবেশীরা।
হুয়ানা বিস্মিত চোখ মেলে চাইল। কিনোর দিকে চেয়ে রয়েছে উজ্জ্বল দৃষ্টিতে। এবার চট করে কোলের বাচ্চাটার দিকে চাইল।
এ কি সত্যিই সম্ভব? ভাবল ও।
আমার ছেলে বই খুলে পড়বে, কথার খেই ধরে কিনে। আমার ছেলে লিখতে শিখবে। অঙ্কও শিখবে। ওর সাথে সাথে আমাদেরও সব শেখা হয়ে যাবে।
মুক্তোটায় চোখ রাখল আবারও কিনো। দেখতে পেল, কাঠের ছোট্ট বাসাটায় আগুনের পাশে বসে ও আর হুয়ানা, ওদিকে বিশাল এক বই খুলে বসেছে কয়েটিটো।
মুক্তাটা আমাদের সব সাধ-আহ্লাদি পূরণ করবে, বলল কিনো।
জীবনে কোনদিন একসঙ্গে এত কথা বলেনি ও, সহসা ভয় পেয়ে গেল। ভীতিবোধের ফলে মুক্তোটা শক্ত করে মুঠোয় চেপে ধরল।
কিনোর মুক্তো দেখার পর থেকে পড়শীরা উপলব্ধি করছে, তারা দর্শনীয় কিছু একটা দেখেছে। আগামী বহু বছরের গাল-গল্পের খোরাক পেয়ে গেছে সবাই। কিনোর স্বপ্ন সার্থক হলে, প্রতিবেশীরা বলতে পারবে, কিনোর চোখ কিভাবে প্রভা ছড়িয়েছিল। তারা বলাবলি করবে, কী এক অদ্ভুত ক্ষমতা কিনোর ভেতর প্রবেশ করে তাকে আশ্চর্য শক্তিশালী করে তুলেছিল।
আর যদি কিনোর স্বপ্ন ব্যর্থ হয়, তবে ভিন্ন ইতিহাস রচনা করা হবে। তখন বলা হবে, নির্বোধের পাগলামি ভর করেছিল কিনোর ওপর, আর তাই কত আগডুম বাগড়ম কথাই না বলেছিল উজবুক লোকটা।
বন্ধ মুঠোর দিকে তাকাল কিনো। ছড়ে যাওয়া জায়গাটা সাদা হয়ে আছে।
সন্ধে লেগে আসছে, ঘন হচ্ছে অন্ধকার। হুয়ানা শালে পুরে বহন করছে বাচ্চাটাকে। ও উঠে গিয়ে অাগুনে কয়েক টুকরো খড়ি জোগাল। উস্কে-ওঠা অাগুন পড়শীদের চেহারায় খেলা করে যাচ্ছে। বাসায় যাওয়ার সময় হয়েছে সবাই টের পাচ্ছে। কিন্তু ওঠার নাম করছে না কেউ। আঁধার গাঢ় হলে, আগুন যখন প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড ছায়া ফেলল দেয়ালে, পরস্পরের সাথে ফিসফাস করতে শুরু করল ওরা।
পাদ্রী আসছেন। ওই যে, এসে পড়েছেন।
পুরুষরা হ্যাট খুলে সরে দাঁড়াল দোরগোড়া ছেড়ে। মহিলারা শালে মুখ ঢেকে মাথা নোয়াল। কিনো আর তার ভাই, হুয়ান টমাস সটান উঠে দাঁড়াল। ভেতরে প্রবেশ করলেন পাদ্রী। বয়স্ক লোক তিনি, চুল পাকিয়ে ফেলেছেন। চোখজোড়ায় ওঁর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি। সবাই তার কাছে শিশুর মতন, এবং তিনি তাদের সাথে কথাও বলেন ছেলে ভুলানো ভঙ্গিতে।
কিনো, মৃদু স্বরে বললেন পাদ্রী। নামজাদা এক লোকের নামে তোমার নাম। গির্জার একজন মহান পাদ্রী ছিলেন তিনি।
পাদ্রী এরপর তাঁর কথাগুলোয় গুরুত্ব আরোপ করলেন।
মানুষকে তিনি বহু কিছু শিখিয়েছেন। তোমার জানা নেই? প্রশ্ন করলেন পাদ্রী। বইতে সবই লেখা আছে।
কয়োটিটোর মাথার দিকে চট করে দৃষ্টি চলে গেল কিনোর। একদিন ওর ছেলেও বইয়ে কি লেখা আছে সব জানবে। এ মুহূর্তে খুব একটা স্বস্তি বোধ করছে না ও। পড়শীদের উদ্দেশে চেয়ে বুঝতে চাইল, অন্যরকম অনুভূতি কেন হচ্ছে তার। পাদ্রী কথার সুতো ধরলেন।
শুনলাম তুমি নাকি মস্ত এক মুক্তো পেয়েছ।
মুঠো খুলে মুক্তোটা মেলে ধরল কিনো। ওটার আকৃতি আর সৌন্দর্য দেখে শ্বাস চাপলেন পাদ্রী।
খোদাকে, যিনি তোমাকে এটা দান করেছেন, শুকরিয়া জানাতে ভোলোনি নিশ্চয়ই, বললেন তিনি। খোদার কাছে প্রার্থনা করলে ভবিষ্যতে তিনি এমনি আরও দেবেন।
কিনো নীরবে মাথা নাড়ে, কিন্তু হুয়ানা এবার নম্র সুরে আলোচনায় যোগ দেয়।
করব, ফাদার, আর আমরা বিয়েটাও করে নেব। কিনো তাই বলেছে। হুয়ানা পড়শীদের দিকে চাইতে তারা সায় জানিয়ে মাথা নাড়ল।