শ্বাসরুদ্ধ হুয়ানা অস্ফুট শব্দ করে উঠল। মুক্তোর গান তখন জোরালো সুরে বাজছে কিনোর মাথার মধ্যে। চকচকে মুক্তোটা কিনোর সব স্বপ্ন সত্যি করবে। ঝিনুক থেকে মুক্তোটা বের করে তালুতে ধরে রইল ও। উল্টেপাল্টে অনিন্দ্যসুন্দর জিনিসটা পরখ করছে সে। হুয়ান একদৃষ্টে চেয়ে রয়েছে কিনোর হাতের দিকে। ওই হাতটাই আঘাত হেনেছিল পাষাণ ডাক্তারটার বাড়ির গেটে। সাগরের নোনা পানি লেগে এখন ধূসর-সাদা রং ধারণ করেছে জখমি জায়গাটা।
সাত-পাঁচ না ভেবেই, কয়োটিটোর কাছে গেল হুয়ানা, বাবার কম্বলে শুয়ে রয়েছে বাচ্চাটা। ঔষধি তুলে ফেলে কাটা পরীক্ষা করল ও।
কিনো, চেঁচিয়ে উঠল সহসা।
কিনো চোখ তুলে চাইতে লক্ষ্য করল, কাঁধ থেকে মিলিয়ে যাচ্ছে বিষ; চলে যাচ্ছে কয়েটিটোর দেহ থেকে। কিনোর হাত এবার মুঠো করে ধরল মুক্তোটা। মাথাটা পেছনে ঝটকা দিয়ে গলা ফাটিয়ে চেঁচিয়ে উঠল সে। চোখ ঘুরছে, দেহ আড়ষ্ট, আকাশের দিকে মুখ তুলে চিৎকার করছে কিনো। অন্যান্য ক্যানুর লোকেরা হাঁ করে চেয়ে রইল ওর দিকে। তারপর দ্রুত বৈঠা। মেরে চলে এল এদিকে।
০৪. বাতাসের গতিতে চাউর হয়ে যায় খবর
বাতাসের গতিতে চাউর হয়ে যায় খবর।
কিনো, হুয়ানা আর অন্যান্য ডুবুরিরা কিনোর খুদে কাঠের বাসাটায় এল, ততক্ষণে রাষ্ট্র হয়ে গেছে কিনো দুনিয়ার সবচেয়ে বড় মুক্তোটা খুঁজে পেয়েছে। বাচ্চারা বলতে পারার আগেই তাদের মায়েরা খবর জেনে বসে আছে।
কাঠের বাড়িগুলোতে তো বটেই বড়লোকদের পাথরের বাড়িতেও ছড়িয়ে গেছে সংবাদটা। পাদ্রীর কানে কথাটা যেতেই, গির্জার মেরামতির চিস্তা ঘাই মারল তার মাথায়। মুক্তোটার মূল্য কত হতে পারে ভাবনা চলল মগজে। কিনো কখনও কয়োটিটোকে গির্জায় নিয়ে এসেছিল কিনা মনে করার চেষ্টা করলেন। আচ্ছা, কিনো আর হুয়ানার বিয়ে কি পড়িয়েছিলেন তিনি?
দোকানদারদের কানে মুক্তোর খবর পৌঁছলে, অবিক্রিত জিনিসপত্রের দিকে প্রথমেই আশান্বিত দৃষ্টি চলে গেল তাদের।
বলাবাহুল্য, ডাক্তারের কানেও খবরটা গেছে। বৃদ্ধা এক মহিলার চিকিৎসা করছিল তখন সে। মহিলার রোগ আর কিছু না, বার্ধক্যজনিত; কিন্তু ডাক্তার সে কথা ফাঁস করবে কেন? বৃদ্ধা মহিলার পকেট কাটতে হবে? কিনোর মুক্তোর কথা শুনে দীর্ঘক্ষণ ও নিয়ে মাথা ঘামাল ডাক্তার।
ওর বাচ্চার চিকিৎসা করব আমি, মনে মনে আওড়াল। বিছের কামড়ের দাওয়াই দেব।
গির্জার সামনে বসে থাকা ভিখিরিদেরও অজানা রইল না খবরটা। খুশিতে হেসে উঠল ওরা। ওদের জানা আছে, গরীব কোন লোক সহসা আঙুল ফুলে কলাগাছ হলে কাঙালিদের ভিক্ষে দেয়।
ডুবুরিদের কাছ থেকে মুক্তো কেনে ব্যবসায়ীরা। বায়ার বলা হয় এদের। শহরে খুদে খুদে অফিস নিয়ে বসে থাকে। কেউ মুক্তো নিয়ে এলে, দর কষাকষি করে খুব অল্প দামে বেচতে বাধ্য করে। মুক্তো কেনা হলে পর, একাকী বসে থাকে ব্যবসায়ীরা। আঙুলে নেড়েচেড়ে দেখে মুক্তোগুলো। কিন্তু এরা আসলে মুক্তোর মালিকানা পায় না। মস্ত বড় এক মুক্তো ব্যবসায়ী এসব ছোট ছোট ব্যবসায়ীদের পয়সা দিয়ে কাজ করায়।
কিনোর মুক্তোর খবর পৌঁছে গেল এদের কানে। উদাস হয়ে গেল তারা, আহা, প্রকাণ্ড মুক্তোটার মালিক যদি হতে পারত। প্রত্যেক ছোট ব্যবসায়ীই মনে মনে সান্ত্বনা পায়, ধনী ব্যবসায়ীটি তো আর চিরদিন বেঁচে থাকবে না। লোকটা মারা গেলে কাউকে না কাউকে তার স্থান নিতে হবে। আমার টাকা থাকলে আমিই হতে পারতাম অমন বড় ব্যবসায়ী, ভাবে সবাই।
কিনোর প্রতি আগ্রহী এখন অনেকে। মুক্তো পাওয়ার খবর শুনে সবার মনেই কিছু না কিছু প্রতিক্রিয়া হয়েছে। সবার স্বপ্নে ভাগ বসিয়েছে কিনোর মুক্তো। তাদের আশা-আকাক্ষার প্রতীক হয়ে উঠেছে মুক্তোটা।
একজন মাত্র মানুষ সবার স্বপ্নসাধ পূরণে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর সে লোকটি হচ্ছে কিনো। কাজেই সে বেচারা নিজের অজান্তেই অনেকের শত্রু হয়ে গেছে।
মুক্তোর খবরটা শহরে যেন অশুভ এক ছায়া ফেলেছে। আর সেই অশুভ ছায়াটা যেন হুল তুলেছে শহরবাসীকে দংশাবে বলে। কাঁকড়াবিছের বিষে গোটা শহর এখন বিষাক্ত হওয়ার অপেক্ষায়।
কিনো আর হুয়ানা কিন্তু এসব কথা ঘুণাক্ষরেও জানে না। তারা মহা আনন্দিত, উত্তেজিত। তাদের ধারণা, আর সবাইও বুঝি তাদের মতই আনন্দে আত্মহারা। বিকেলে, পাহাড় টপকে সূর্যটা যখন টুপ করে সাগরে পড়েছে, কিনো তখন তার কাঠের বাড়িতে বসে। তার পাশে বসা হুয়ানা। বাসায় গিজগিজ করছে প্রতিবেশী। কিনোর হাতে ধরা মুক্তোটা উষ্ণ আর প্রাণবন্ত অনুভূতি ছড়াচ্ছে। পড়শীরা মুক্তোটা চেয়ে চেয়ে দেখছে। আশ মিটছে না যেন কারও। মানুষের কপাল এতখানি খোলে কিভাবে পরস্পর আলোচনা করছে তারা। কিনোর ভাই, হুয়ান টমাস, ওর একপাশে বসে।
তুই তো এখন ধনী মানুষ, কি করবি ভাবছিস? জানতে চায় সে।
মুক্তোটায় চোখ রাখল কিনো। হুয়ানা মাথা নিচু করে মুখ লুকাল শালে, প্রতিবেশীরা যাতে ওকে দেখতে না পায়।
দ্যুতি ছড়ানো মুক্তোটার দিকে চেয়ে কত অপূর্ণ স্বপ্নের কথাই বিভোর হয়ে ভাবছে কিনো। মুক্তোটার মধ্যে সে নিজের, হুয়ানার আর কয়োটিটোর ছবি দেখতে পাচ্ছে। গির্জায় গেছে ওরা। পাদ্রীর খরচ মেটাতে পারবে, ফলে এতদিনে বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা সারছে।