ভিখিরিরা ডাক্তারটিকেও চেনে। সে যে কী চিজ ভাল করেই জানা আছে তাদের। লোকটা টাকা ছাড়া দুনিয়ায় আর কিছু বোঝে না। রোগীর রোগ সারাতে পারে না লোকটা, তাও তাদের জানা। গির্জার ভেতর লাশগুলো ওদের নাকের ডগা দিয়েই তো ঢোকে।
গির্জায় এখন কেউ নেই। টাকাঅলা কেউ গির্জায় ঢোকেনি, ব্যবসা মন্দা, ফলে কিনো আর হুয়ানাকে অনুসরণ করছে ভিখিরিরা। কুড়ের হদ্দ, মোটা ডাক্তারটা কি চিকিৎসা দেয় বাচ্চাটিকে জানতে আগ্রহী ওরা।
ডাক্তারের বাড়ির প্রকাণ্ড ফটকটার কাছে এসে থেমেছে জনতা। বাড়ির ভেতর থেকে রান্নার সুঘ্রাণ ভেসে আসছে। কিনোর মাথার ভেতর ঘুরপাক খাচ্ছে ডাক্তারটির কথা।
লোকটা কিনোর স্বগোত্রীয় নয়। প্রায় চারশো বছর ধরে কিনোর গোত্রের ওপর লুটপাট আর অত্যাচার চালাচ্ছে ডাক্তারের গোত্র। প্রচণ্ড ক্রোধ আর ভীতি অনুভব করে কিনো, যখনই প্রতিপক্ষের কারও সামনাসামনি হয়। কিনো অনুভব করছে, কথা বলার চাইতে বরং ডাক্তারটিকে খুন করাই সহজ হবে তার পক্ষে। ডাক্তারের গোত্রের লোকেরা এমনভাবে কিনোর গোত্রের মানুষদের সাথে কথা বলে, তারা যেন জন্তু-জানোয়ার।
দরজায় টোকা দিতে ডান হাত তুলল কিনো। ভেতর ভেতর রাগ ফেনিয়ে উঠছে ওর। ঠোঁটজোড়া পরস্পরের সাথে শক্ত হয়ে চেপে রয়েছে, কিন্তু তারপরও বাঁ হাতে হাট খুলে নিল ও। গেটে টোকা দিয়ে অপেক্ষা করতে লাগল কিনো। হুয়ানার কোলে ডুকরে কেঁদে উঠল কয়োটিটো। মৃদু কণ্ঠে বাচ্চার সাথে কথা বলল হুয়ানা। জনতা কাছিয়ে এল কি হয় দেখতে। শুনতেও।
মুহূর্ত পরে, মস্ত গেটটা কইঞ্চি ফাঁক হলো। গেট যে খুলেছে সে কিনোর এক জ্ঞাতি ভাই। ইন্ডিয়ান ভাষায় তার সাথে কথা বলল কিনো।
আমার বাচ্চাটাকে, বলল কিনো। বিছেয় কামড়েছে।
গেট লেগে যেতে শুরু করল। কিনোর জ্ঞাতি ভাই, অর্থাৎ কাজের লোকটা, ইভিয়ান ভাষায় কথা বলতে গররাজি।
একটু দাঁড়াও, স্প্যানিশে বলে গেটটা লাগিয়ে দিল লোকটা। সাদা দেয়ালে ছায়া পড়েছে জনতার।
নিজের কামরায় বিছানার ওপর বসে ছিল ডাক্তার। লাল সিঙ্কে তৈরি ড্রেসিং গাউন তার পরনে। কাপড়টা এসেছে প্যারিস থেকে। সুদৃশ্য কাপ থেকে গরম চকোলেট পান করছে লোকটা। আলতো হাতে কাপটা ধরে রয়েছে সে। অসন্তুষ্ট দেখাচ্ছে তাকে।
ডাক্তারের পাশে, টেবিলে খুদে এক কলিং বেল আর কিছু সিগারেট। কামরার আসবাবপত্র, পর্দা সবই ভারী আর কালচে। ঘরে লটকানো ছবিগুলো ধর্মের বাণী প্রচার করছে। তবে বিশাল এক রঙীন ছবিও রয়েছে। ডাক্তারের স্ত্রীর। ভদ্রমহিলা মারা গেছেন।
ডাক্তার আরেক কাপ চকোলেট পান করল, একটা বিস্কুট মুখে দিল। গেট খুলতে-যাওয়া লোকটা খোলা দরজার কাছে এসে অপেক্ষা করছে।
কি? ডাক্তার বলল।
বাচ্চা নিয়ে এক ইন্ডিয়ান এসেছে, বলল লোকটা। বাচ্চাটাকে বিছেয় কামড়েছে।
ডাক্তার ধীরে ধীরে কাপটা নামিয়ে রাখল, খেপে উঠছে সে।
ইন্ডিয়ানদের বাচ্চাদের ভাল করা ছাড়া আর কি কোন কাজ নেই আমার? গর্জে উঠল। আমি কি পশুর ডাক্তার?
এবার দুমুহূর্ত কি যেন ভেবে নিয়ে আবার বলল, ইডিয়ানদের কাছে পয়সা থাকে না। যাও, গিয়ে দেখে এসো ওর কাছে আছে কিনা।
যাই, স্যার।
কাজের লোকটা গেট সামান্য ফাঁক করে অপেক্ষমাণ জনতার উদ্দেশে চাইল। এবার ইন্ডিয়ান ভাষায় কথা বলল লোকটা।
তোমার টাকা আছে? জানতে চাইল।
কম্বলের নিচে হাত দিল কিনো। বের করে আনল এক টুকরো কাগজ। কাগজটা আস্তে আস্তে খুলল ও, লোকটা যাতে মুক্তো আটখানা দেখতে পায়। ধূসর, হতশ্রী মুক্তোগুলো প্রায় মূল্যহীন। ওগুলো হাতে নিয়ে গেটটা ফের বন্ধ করল ভূত্য। খুব দ্রুত ফিরে এল সে এবার। গেট খুলে মুক্তো ফিরিয়ে দিল কিনোর হাতে।
ডাক্তার বাসায় নেই, বলল। রোগী দেখতে চলে গেছেন। লজ্জিত বোধ করছিল, তাই ঝট করে গেট বন্ধ করে দিল লোকটা।
উপস্থিত সব লোক লজ্জায় অধোবদন, তারা কেউ কিনোকে সাহায্য করতে পারছে না। ধীরে ধীরে সরে পড়তে লাগল জনতা। গির্জার সিড়িতে ফিরে গেল ভিখিরির দল। বাড়ি ফিরে গেল কিনোর বন্ধু-বান্ধবরা। কিনো আর হুয়ানার কথা এবং লজ্জাবোধ ভুলে যেতে চেষ্টা করল তারা।
গেটটার সামনে দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল স্বামী-স্ত্রী। ধীরেসুস্থে মাথায় হ্যাটটা চাপাল কিনো। তারপর আচমকা দুম করে এক ঘুসি মেরে বসল গেটের গায়ে। চোখ নামাতে, আঙুলের ফাঁক গলে রক্ত গড়াতে দেখল ও। অবাক হয়ে গেল কিনো।
০৩. মুক্তো-ডুবুরিদের কাঠের বাসাগুলো
মুক্তো-ডুবুরিদের কাঠের বাসাগুলো সাগরতীরের কাছে, শহরের ডান প্রান্তে। বাড়িগুলোর সামনে ক্যানু রয়েছে। কিনো হুয়ানাকে নিয়ে শ্লথ পায়ে নিজেদের ক্যানুর কাছে এল। যাবতীয় সম্পত্তির মধ্যে ক্যানুটাই কিনোর সবচাইতে মূল্যবান সম্পদ। ক্যানুটা বহু পুরানো। কিনোর বাপ-দাদার ছিল ওটা। উত্তরাধিকার সূত্রে এখন জিনিসটা কিনোর।
যার ক্যানু আছে তার না খেয়ে মরার ভয় নেই। প্রতি বছর ক্যানুটায় প্রলেপ মাখায় কিনো, ওর বাবা শিখিয়েছিল। ক্যানুর বাইরেটায় প্রলেপ ক্রমান্বয়ে শক্ত হয়ে, ওটাকে শক্তিশালী আর নিরাপদ করে তোলে।
ক্যানুর তলদেশে ডাইভিং স্টোন, ঝুড়ি আর দড়ি নামিয়ে রাখল কিনো। তারপর কম্বলটা ভাঁজ করে সেটাও রাখল।
ব্লাঙ্কেটে কয়োটিটোকে শোয়াল হুয়ানা। শাল দিয়ে ঢেকে দিল বাচ্চাটাকে, রোদে যাতে কষ্ট না পায়। কয়োটিটো এখন শান্ত। কিন্তু ক্ষতস্থানটা ওর ক্রমেই আরও খারাপের দিকে যাচ্ছে, হুয়ানা লক্ষ্য করল বিষ ঘাড়ের কাছে উঠে কানের লতি অবধি পৌঁছে গেছে। কয়েটিটোর মুখের চেহারায় তপ্ত আর লালচে ভাব।