গুড়ি মেরে গুহামুখের কাছে এসে বাইরে উঁকি দিল হুয়ানা। নীড় থেকে যেন গলা বাড়িয়েছে, কোন পাহাড়ী পাখি। কয়েটিটো হুয়ানার পিঠে বাঁধা কম্বলের নিচে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। মার কাঁধে আর ঘাড়ে বিশ্রাম পাচ্ছে ওর মাথা। নিঃশব্দে দোয়া পড়ে চলেছে হুয়ানা।
হুয়ানা গুহার বাইরে চোখ রাখতে, আঁধার খানিকটা পাতলা হয়েছে লক্ষ্য করল। পুবে আলো পাচ্ছে আকাশ। নিচে দৃষ্টি নিবদ্ধ করতে, রাইফেলধারীর আলোকিত সিগারেট দেখতে পেল ও।
পাথর বেয়ে ধীরেসুস্থে নামছে কিনো৷ পিঠের দিকে ঝুলিয়েছে ছোরাটা, পাথরে যাতে বাড়ি না খায় ওটা। আঙুলে আর পায়ের পাতায় ভর দিয়ে নেমে যাচ্ছে কিনো, পড়ে যাতে না যায় তাই চেপে থাকছে পাথরের সাথে। যে কোন শব্দ, এমনকি নুড়ি পাথর খসে পড়লেও, সচকিত করে দেবে শত্রুদের। আর রাইফেলধারী কোন কারণে ওপরদিকে চাইলেই হয়েছে। কিন্তু আজ রাতটা অতখানি নিস্তব্ধ নয়। কীট-পতঙ্গ কোরাসে গান গেয়ে ভরাট করে রেখেছে উপত্যকা।
উতরাই ভেঙে ধীরে আর নিঃশব্দে নেমে যাচ্ছে কিনো। ওর একটা পা কয়েক ইঞ্চি নড়ে, তারপর দুপায়ের পাতা ভরিসাম্য রক্ষা করে পাথরের ওপর। অপর পা একটু এগোয় তো একটা হাত সামান্য নেমে যায় নিচের দিকে। এরপর অপর হাত নেমে যায়, কিনোর গোটা দেহ যতক্ষণ পর্যন্ত না অতি ধীরে নড়াচড়া করে। মুখ হাঁ কিনোর। এরফলে শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ হওয়ার আশঙ্কা নেই।
নিচে নিশ্চিন্তে বিশ্রামরত লোকগুলো শব্দ শুনে চোখ তুললে, পাথরের পটভূমিতে কিনোর আদল দেখতে পাবে। ধীরে, খুব ধীরে নড়তে চড়তে হচ্ছে কিনোকে। কোনমতেই লোকগুলোর সন্দেহ জাগানো চলবে না। বহুক্ষণ লেগে গেল উতরাই বাইতে। নিচে নামার পর, ছোট এক গাছের আড়াল নিল সে। বুকের মধ্যে ধুপধাপ লাফাচ্ছে হৃৎপিণ্ড, দুহাত আর মুখখানা ঘামে ভিজে পিচ্ছিল। ঝুঁকে পড়ে বুক ভরে শ্বাস টানল কিনো।
লোকগুলোর সাথে এখন ওর আর মাত্র বিশ ফিট ফারাক। জমির চরিত্র মনে করার চেষ্টা করল ও। রাস্তায় বড় কোন পাথর ছিল কি? পা দুখানা ভাল করে ডলে নিল কিনো, পাহাড় বেয়ে নামার পর থেকে থরথর করে কাঁপছে ওদুটো।
পুবাকাশে এবার দৃষ্টি প্রসারিত করল ও।
শীঘ্রিই চাঁদ উঠছে। তার আগেই আক্রমণ শানাতে হবে ওকে।
উপত্যকায় ঘন হচ্ছে আলো। ঘুমন্ত লোক দুটোকে দেখতে পাচ্ছে কিনো। পাহারাদারটিকে প্রথমেই খসাতে হবে ওর। নিঃশব্দে, কাঁধের ওপর ছোরার হাতল বাগিয়ে ধরল কিনো।
কিন্তু দেরি করে ফেলেছে ও। সিধে হয়ে দাঁড়াতে, পুবে উদয় হলো চাঁদ। গাছটার পেছনে লুকাতে বাধ্য হলো আবার কিনো।
আঁধার কেটে যাচ্ছে উপত্যকায়। ডোবার কাছে, পাহারাদার লোকটা ছোট্ট এক টিলায় চড়ে বসে আছে। শোভা উপভোগ করছে চাঁদের। ফস করে আরেকটা কাঠি জ্বালতে, নিমেষের জন্যে আলোটা ঝিকিয়ে উঠল ওর মুখের চেহারায়। কিনোর আর দেরি করার উপায় নেই। লোকটা মাথা ফেরানো মাত্র, লাফিয়ে পড়বে ও। পা দুখানা তৈরি ওর। ঠিক এমনি সময়, অনেক ওপর থেকে, চ্যাঁ করে কেঁদে উঠল একটা বাচ্চা। প্রহরী ঘাড় কাত করল শোনার জন্যে, তারপর সটান উঠে দাঁড়াল। মাটিতে শোয় একজন ট্র্যাকার নড়েচড়ে উঠল অস্থির ভাবে। এবারে উঠে বসে চারধারে দৃষ্টি বুলাতে লাগল।
কি ব্যাপার? ও কিসের শব্দ? সজাগ হয়ে প্রশ্ন করল ও।
কে জানে, দ্বিতীয় লোকটা ঘুম ভেঙে বলল। বুনো কুকুরের বাচ্চা হতে পারে। কুকুরছানারা তো বাচ্চাদের মত করেই কাঁদে।
কপাল বেয়ে ঘাম গড়িয়ে পড়ে, জ্বলে গেল যেন কিনোর চোখজোড়া। বাচ্চার কান্নার শব্দ আবারও ভেসে এল। পাহারাদারের দৃষ্টি পাহাড়ের গা বেয়ে উঠে গেল অন্ধকার গুহাটার উদ্দেশে।
ওখানে মনে হয় কোন বুনো কুকুর আছে, বলল লোকটা।
নড়াচড়ার শব্দ পেল কিনো, লোকটা রাইফেলের গুলি বর্ষাতে তৈরি হতে।
কুকুর হলে এতে ঠাণ্ডা মেরে যাবে, বলল সে। গুহার উদ্দেশে তাক করল অস্ত্র।
রাইফেলটা গর্জে উঠতে সামনে ঝাঁপ দিল কিনো। ওর বিশাল ছোরাটা গেঁথে গেল লোকটার বুকে। মাথায় খুন চেপে গেছে এখন কিনোর। এক হাতে রাইফেল চেপে ধরেছে সে। অপর হাতে ছোরাটা টেনে বের করে অনিল লোকটার বুক থেকে।
দ্রুত দেহ ভঙ্গি বদলে নিল কিনো। পাঁই করে ঘুরে দাঁড়িয়ে আঘাত হানল দ্বিতীয় লোকটার মাথায়। তৃতীয় জন শরীর হেঁচড়ে সরে গেল জলাশয়ের উদ্দেশে। তারপর পাথর স্থূপ বেয়ে ঝর্ণাধারার উৎস লক্ষ্য করে উঠে যেতে লাগল। লোকটার হাত আর পা জড়িয়ে গেল ঝোপের গায়ে। চড়াই ভাঙতে গিয়ে চেঁচাতে লাগল সে। কিন্তু কিনো এ মুহূর্তে নির্দয়-নিষ্ঠুর। রাইফেলের লক্ষ্যস্থির করে গুলি চালিয়ে দিল। চিত হয়ে, ঝপাং করে জলাশয়ের পানিতে পড়ল লোকটা। ডোবার কাছে এসে দাঁড়াল কিনো। চাঁদের আলোয়, লোকটার আতঙ্কিত চোখজোড়া দেখতে পেল। দুচোখের মাঝখান বরাবর দ্বিতীয় গুলিটা চালাল ও।
স্থাণুর মত দাঁড়িয়ে, ওপরে, গুহার দিকে চোখ তুলে তাকাল কিনো। কোথাও কোন একটা গোলমাল হয়েছে। পোকা-মাকড় এ মুহূর্তে কোলাহল ভুলে একদম থম মেরে আছে। উৎকর্ণ হলো কিনো। শব্দটা ওর চেনা। পাহাড়ী গুহাটার অভ্যন্তর থেকে শোকাকুল বিলাপধ্বনি কানে আসছে। কণ্ঠস্বরটা হুয়ানার। আপনজনের মৃত্যু ঘটলে এভাবে কাঁদে মানুষ।
১২. অনেক দিন পর
অনেক দিন পর। শহরের সবার আজও মনে আছে কিনো আর আ হুয়ানার ফিরে আসার দিনটির কথা। রীতিমত সাড়া পড়ে যায় চারদিকে সেদিন। জনাকয় বৃদ্ধ নিজের চোখে ওদের ফিরে আসতে দেখেছে। অন্যরা ও ঘটনার কথা শুনেছে বাপ-দাদার মুখে। কিন্তু দিনটার কথা স্মরণ করে সবাই।