তৃষ্ণার্ত কিনো আঁজলা ভরে পানি তুলে আকণ্ঠ পান করল। তারপর সটান হলো ডোবার ধারে। খানিকক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে উঠে দাঁড়াল ও। দৃষ্টি প্রসারিত করল পাহাড়ের গা বরাবর নিচের দিকে। যা দেখল তাতে জমে গেল সে। পাহাড়ের পায়ের কাছে পৌঁছে গেছে ট্র্যাকাররা। যদিও বহু দূরে এখনও ওরা। কিনোর চোখে এখনি থেকে ওদেরকে পুতুলের মত দেখাল।
হয়না ঘুরে চাইল, কিনো কি করছে দেখতে।
আর কদূর? স্বামীকে থম হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে শুধাল।
সন্ধে নাগাদ এখানে পৌঁছে যাবে।
চোখ তুলে উপত্যকার দিকে তাকাল কিনো, ঝর্ণাধারা নামছে যেখান থেকে।
আরও উচুতে উঠে যেতে হবে আমাদের, বলল ও।
১১. চেয়ে ছিল কিনো
চেয়ে ছিল কিনো, বেশ কয়েকটা গুহা লক্ষ্য করল। পাথুরে পাহাড়টির প্রায় ত্রিশ ফিট মত ওপরে ওগুলো। হাঁচড়ে পাঁচড়ে পাথর বেয়ে উঠতে শুরু করল কিনো। বাতাসে ক্ষয়ে ক্ষয়ে তৈরি হয়েছে কয়েক ফিট গভীর এই গুহাগুলো। সবচেয়ে বড়টার মধ্যে হামাগুড়ি দিয়ে ঢুকে শুয়ে পড়ল কিনো। বাইরে থেকে দেখা যাবে তার ভয় নেই। বুকে হেঁটে গুহাটা ছেড়ে বেরিয়ে এসে, তরতর করে নিচে নেমে এল ও।
ওখানে চলো, হুয়ানাকে বলল। আমাদের ওখানে খুঁজে নাও পেতে পারে।
বিনাবাক্যে মেনে নিল হুয়ানা। পানির বোতলটা ভরে নিল। কিনো ওকে গুহায় উঠতে সাহায্য করল। এরপর খাবারের প্যাকেটগুলো নিচে থেকে নিয়ে এল কিনো, চালান করল হুয়ানার হাতে। গুহামুখে চারদিকে নজর রাখতে বসল হুয়ানা।
হুয়ানা লক্ষ্য করল কিনো ওদের ট্রাক মোছার কোন চেষ্টাই করল না। তার বদলে, ডোবার পাশের পাথরে উঠে খুদে চারাগুলো টেনে তুলতে লাগল। শখানেক ফিট ওঠার পর, আবারও নেমে এল কিনো। গুহামুখে গিয়ে মেশা পাথরগুলো সাবধানী দৃষ্টিতে পরখ করল। কোন চিহ্ন ফেলে যাচ্ছে না লক্ষ্য করে উঠে এল গুহায়, গুটিসুটি মেরে বসে পড়ল হুয়ানার পাশে।
যে চিহ্নগুলো রেখে এলাম ট্র্যাকাররা ওগুলো অনুসরণ করবে, বলল কিনো। ওরা ওখানে উঠে গেলে, আমরা নেমে যাব। কিন্তু ভয় হচ্ছে, কয়োটিটো না কেঁদে ওঠে। ও কাঁদলেই কিন্তু সর্বনাশ।
কাঁদবে না, বলল হুয়ানা। বাচ্চাটাকে দুহাতে তুলে ধরে চোখের দিকে চাইল। কয়েটিটোও মার দিকে একদৃষ্টে চেয়ে।
কাঁদা চলবে না বুঝতে পেরেছে ও, বলল হুয়ানা।
গুহামুখের কাছে শুয়ে কিনো। পাহাড়ের ছায়া জমির ওপর দিয়ে বিস্তার পেয়ে পৌঁছে গেছে সাগর অবধি। একটু পরে গোটা চরাচর গ্রাস করল ছায়া।
দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করল কিনো আর হুয়ানা। সন্ধের আগে ডোবার কাছে পৌঁছতে পারল না অনুসরণকারীরা। এখন তিনজনই পায়ে হাঁটছে, ঘোড়াটা যেহেতু পাহাড়ের পাশ বেয়ে উঠতে পারবে না। গুহার ভেতর থেকে পুতুলের মত দেখাচ্ছে লোকগুলোকে। ডোবার কাছে, ছোট্ট তীরটায় ট্র্যাকার দুজন ঘোরাফেরা করছে। কিনোর ট্র্যাক পাহাড় বেয়ে উঠে গেছে লক্ষ্য করল ওরা। রাইফেলধারী বসে পড়ল বিশ্রাম নিতে। অন্য লোক দুজনও তার দেখাদেখি বসল। ওদের সিগারেটের আগুন দেখতে পাচ্ছে কিনো। লোকগুলো খেতে বসেছে, ওদের কথাবার্তার অস্ফুট শব্দ মাঝেমধ্যে ভেসে আসছে বাতাসে।
রাত ঘনাল উপত্যকায়। নিশাচর জন্তুর পানি খেতে এসেছিল ডোবার কাছে। কিন্তু মানুষের গন্ধ পেয়ে আঁধারে সটকে পড়েছে। পেছনে শব্দ শুনতে পেল কিনো। ফিসফিস করছে হুয়ানা, কয়োটিটো। বাচ্চাটাকে চুপ থাকতে বলছে। শাল দিয়ে বাচ্চার মাথা মুড়ে রেখেছে সে।
নিচে, ডোবার কাছে দিয়াশলাই জ্বালল একজন। অন্য দুজন ঘুমাচ্ছে, কুকুরের মত কুণ্ডলী পাকিয়ে। তৃতীয় জন পাহারা দিচ্ছে। দিয়াশলাইয়ের আগুনের আলোয় লোকটার রাইফেল দেখতে পেল কিনো। নিভে গেল কাঠি, কিন্তু কিনোর জানা থাকল প্রতিপক্ষের অবস্থান।
নিঃশব্দে গুহার ভেতর এসে ঢুকল ও। উজ্জ্বল একজোড়া তারার মত জ্বলছে হুয়ানার চোখ। গুড়ি মেরে ওর কাছ ঘেঁষে এল কিনো, মুখ নিয়ে এল কানের কাছে। ওদের মোকাবিলা করার একটা রাস্তা আছে, বলল।
তুমি মারা পড়বে। ওদের সাথে রাইফেল আছে।
রাইফেলঅলাকে কায়দা করতে পারলে আর চিন্তা নেই, জবাবে বলল কিনো। অন্য লোক দুটো ঘুমাচ্ছে।
শালের তল থেকে বেরিয়ে এসে কিনোর বাহু চেপে ধরল হুয়ানার হাত।
তারার আলোয় তোমার গায়ের সাদা জামা দেখে ফেলবে ওরা।
না, তারার আলোকে ভয় পাচ্ছি না, বলল কিনো। কিন্তু চাঁদ ওঠার আগে যেতে হবে আমাকে।
হুয়ানাকে বলার মত সান্ত্বনার বাণী হাতড়াচ্ছে কিনো। ওরা আমাকে মেরে ফেললে, বলল ও। চুপচাপ এখানে বসে থেকো। ওরা ফিরে গেলে ডুবুরিপাড়ায় চলে যেয়ো।
গলা কেঁপে গেল হুয়ানার। খোদা তোমার সহায় হোন।
কিনো কাছ থেকে হুয়ানার আয়ত চোখজোড়া খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে লক্ষ্য করল, এবার হাত বাড়াতে কয়োটিটোকে খুঁজে পেল। বাচ্চাটার মাথায় এক মুহূর্ত স্থির হলো ওর হাত। হুয়ানার গাল স্পর্শ করল তারপর ও। শ্বাস চেপে স্বামীকে গুহা থেকে বুকে হেঁটে বেরিয়ে যেতে লক্ষ্য করল হুয়ানা। একদম একা হয়ে যাচ্ছে, কেমন করে উঠল বুকের ভেতরটা ওর।
গুহামুখের কাছে মুহূর্তের জন্যে দাঁড়িয়ে থাকল কিনো। আকাশের বিপরীতে ওকে দেখতে পাচ্ছে হুয়ানা। সাদা পোশাক খুলে ফেলেছে গা থেকে কিনো। মিশমিশে অন্ধকারে কিনার বাদামী চামড়া কারও দৃষ্টি কাড়বে না। গলায় মস্ত ছোরাটা ঝুলিয়েছে কিনো, হাত দুটো যাতে মুক্ত থাকে। সামনে ঝুঁকে পড়ে দুমুহূর্ত চেয়ে রইল কিনো। তারপর সহসাই, মিশে গেল রাতের আঁধারে।