কাঠের খুদে বাড়িটা ধীরে ধীরে উত্তপ্ত হয়ে উঠছে, রোদের তেজ বাড়াতে। দেয়ালের ফুটো দিয়ে আলোর ছটা ঘরে এসে পড়ছে। কয়েটিটোর গায়েও সূর্যকিরণ এসে পড়েছে। দোলনায় নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে বাচ্চাটা। হঠাৎ দেখা গেল কি যেন একটা দড়ি বেয়ে নেমে আসছে। কিনো আর হুয়ানা মূর্তির মত দাঁড়িয়ে থেকে লক্ষ্য করছে ওটাকে। একটা কাঁকড়া বিছে, লেজটাকে পেছনে খাড়া করে রেখেছে। লেজের আগা দিয়ে দংশন করলে আর রক্ষে নেই, নিশ্চিত মৃত্যু। কাউকে কামড় দিতে চাইলে বিছে তার মাথার ওপর দিয়ে ভাঁজ করে আনে লেজটাকে।
নাক দিয়ে ফোঁস ফোঁস নিঃশ্বাস পড়ছিল কিনোর, শব্দটা বন্ধ করার জন্যে মুখ খুলল ও। রশি বেয়ে ধীরেসুস্থে নেমে আসছে সাক্ষাৎ যম, এগোচ্ছে দোলনাটার উদ্দেশে। নীরবে প্রার্থনা করতে শুরু করেছে মা। নিঃসাড়ে ঘর পেরিয়ে এদিকে চলে এল কিনো, দুহাত সামনে বাড়িয়ে। দৃষ্টি স্থির ওর কাকড়াবিছেটার ওপর। বিছেটার নিচে, ঝুলন্ত বাক্সে, হেসে উঠে শূন্যে হাত তুলে দিল কয়োটিটো। হাতটা লক্ষ্য করে থমকে গেল শিকারী। মাথার ওপর দিয়ে লেজটা মুড়ে আনছে ওটা। লেজের ডগায় হুলটা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে কিনো।
স্থাণুর মত দাঁড়িয়ে থেকে, ধীরে, অতি ধীরে হাতটা বাড়াল ও। বিছেটার লেজ ভাজ খেয়েছে আবারও। ঠিক সে মুহূর্তে, কিনোর হাত দড়ি স্পর্শ করতে খসে পড়ল ওটা। ঝটিতি থাবা মারল কিনা, কিন্তু বিছেটা ওর আঙুল ফাঁকি দিয়ে, সোজা গিয়ে বাচ্চাটার কাঁধের ওপর পড়ল। আর যায় কোথায়, সঙ্গে সঙ্গে দংশাল কয়োটিটোকে।
পশুর মত গর্জন ছাড়ল কিনো। বিছেটাকে তুলে নিয়ে চেপে ধরল দুহাতের তালুতে। তারপর মেঝেতে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে পিটিয়ে মারল। ওদিকে তারস্বরে চেঁচাচ্ছে তখন কয়েটিটো।
বাচ্চাকে কোলে তুলে নিল হুয়ানা। লাল ক্ষতটা খুঁজে নিয়ে মুখ রাখল ওখানে, চুষছে। যতখানি সম্ভব বিষ বের করে থুথু দিয়ে মেঝেতে ফেলল।
মা আবার জখমে মুখ দিতে আর্তচিৎকার করতে লাগল কয়েটিটো। কিনো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছে। আর কিইবা করার আছে তার।
বাচ্চাটার কান্নার শব্দ কানে যেতে পড়শীরা বেরিয়ে এল যার যার বাড়ি থেকে। কিনোর ভাই, হুয়ান টমাস, তার ইয়া মোটা স্ত্রী অ্যাপোলোনিয়া আর চার সন্তানকে নিয়ে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে রইল। প্রতিবেশীরা সবাই ঘরের ভেতর উঁকিঝুঁকি মারছে। ছোট এক ছেলে এক পড়শীর দুপায়ের ফাঁক দিয়ে কি হচ্ছে দেখার চেষ্টা করছে। সামনের লোকেরা ঘটনার বর্ণনা দিচ্ছে পেছনের লোকেদের।
বিছে! বলল তারা। বাচ্চাটাকে বিছেয় কামড়েছে!
মুহূর্তের জন্যে ক্ষতস্থান থেকে মুখ সরাল হুয়ানা। লালচে জখমটা ক্রমেই বড় হচ্ছে। উপস্থিত সবাই কাঁকড়াবিছেকে হাড়ে হাড়ে চেনে। বিছের দংশনে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়তে পারে বড় মানুষ, কিন্তু সহজেই মারা পড়তে পারে শিশুরা। জখম প্রথমটায় বড় হতে থাকে, তারপর শুরু হয় জ্বর আর পেট ব্যথা।
কামড়ের ব্যথাটা কমে যাচ্ছে। এখন আর চেঁচামেচি করছে না কয়োটিটো, নীরবে কাঁদছে। হুয়ানা ছোটখাট হলেও শক্ত ধাঁচের মহিলা। খেয়ে না খেয়ে প্রচণ্ড পরিশ্রম করতে পারে। অসুখ হলে কক্ষনো ডাক্তার ডাকতে বলে না। কিন্তু এমুহূর্তে বড় অদ্ভুত এক কাণ্ড করল ও।
ডাক্তার, বলল। যাও, ডাক্তার নিয়ে এসো।
০২. ডাক্তার আসবে না
ডাক্তার আসবে না, দরজায় দাঁড়ানো প্রতিবেশীরা বলল।
না, হুয়ানাকে বলল কিনে। ডাক্তার আমাদের এখানে আসবে না।
হুয়ানা কিনোর দিকে চাইল। ওর চোখজোড়া শীতল, নিস্পৃহ। কয়েটিটো হুয়ানার প্রথম সন্তান। তার সাত রাজার ধন মানিক।
তাহলে আমরাই যাব, বলল সে। শালের এক প্রান্ত দিয়ে মাথা ঢাকল হুয়ানা। শালের অন্য কিনারা রাখল
বাচ্চাটার চোখের ওপর। দোরগোড়ায় সমবেত মানুষগুলো পেছনে চেপে দাঁড়ালে হুয়ানা বেরিয়ে পড়ল। কিনো আর হুয়ানা গেট পেরিয়ে ছোট পথটা ধরল। ওদের অনুসরণ করছে পড়শীরা। কিনো আর হুয়ানার সাথে তারাও ডাক্তারের কাছে যাচ্ছে।
শহরের প্রাণকেন্দ্রে দ্রুত পা চালিয়ে চলে এল ওরা। মাটিতে কালো কালো ছায়া ফেলেছে জ্বলন্ত সূর্য। সমস্ত লোকজন আর তাদের কালো ছায়ারা শহরের উদ্দেশে হনহন করে এগিয়ে চলেছে।
কাঠের ছোট বাসাগুলো ছাড়িয়ে পাথুরে বাড়ি শুরু হয়েছে, সেখানে এসে হাজির হলো দলটা। প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড দেয়াল ঘেরা বাগান রয়েছে শহরের এ অঞ্চলে। দেয়ালের ওপর লটকে রয়েছে নানা রকমের লাল, সাদা ফুল। বাগানে খাচাবন্দী পাখিরা গান গাইছে, শুনতে পাচ্ছে হুয়ানা অার কিনো।
গরীব মানুষগুলো স্কয়্যার পেরিয়ে, গির্জার সামনে দিয়ে হেঁটে এসেছে। অনুসরণকারীর সংখ্যা ইতোমধ্যে আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। সবার মুখে কয়োটিটো আর বিছের কামড়ের কথা। জনতা জানে ওরা স্বামী-স্ত্রী বাচ্চাটাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাচ্ছে।
গির্জার সামনে বসে থাকা ভিখিরির দল কিনো আর হুয়ানার দিকে চেয়ে ছিল। হুয়ানার নীল রঙা শতচ্ছিন্ন স্কার্ট, আর অসংখ্য ফুটোঅলা শালটা দেখেছে ওরা। কিনোর ছেড়া কম্বলটার দিকেও তাদের কৌতূহলী দৃষ্টি ছিল। লোকটা গরীব, স্পষ্ট বোঝা যায়। দেখি তো কি হয়, এই ভেবে ভিখিরিরাও পিছু নিয়েছে ওদের।
শহরের নাড়ী-নক্ষত্র ভিখিরিগুলোর জানা। ছোট-বড় সমস্ত অপরাধের খুঁটিনাটি তাদের নখদর্পণে। গির্জার বাইরে ঘুমায় ওরা। ওদের অজান্তে এ শহরে কিছুই ঘটার জো নেই।