কিনো তরাস খেয়ে গেছে। আমাদের ছেলেকে লেখাপড়া শেখাতে হবে, বলল ও।
মুক্তোর দিকে চোখ রেখে, ছেলে বই পড়ছে, এ ছবিটা ফোটাতে চেষ্টা করল মনের পর্দায়। কিন্তু তার বদলে, কয়েটিটোকে অসুস্থ করে দিয়েছিল যে হতচ্ছাড়া ডাক্তারটা, তার কথা প্যাঁচ খেয়ে রইল মগজে।
অগত্যা এসব চিন্তা বাদ দিয়ে মুক্তোটা ফের পকেটে ঢোকাল কিনো।
১০. গরমের জ্বালায় অতিষ্ঠ কিনো আর হুয়ানা
গরমের জ্বালায় অতিষ্ঠ কিনো আর হুয়ানা ঝোপের ছায়ায় আশ্রয় নিল।
খুদে পাখির তুড়ুক তুড়ুক চলেফিরে বেড়াচ্ছে আশপাশে।
হ্যাট দিয়ে চোখ ঢাকল কিনো, মাছির উপদ্রব থেকে রক্ষা পেতে মুখ ঢেকে নিল কম্বলে। তারপর দিল ঘুম।
কিন্তু হুয়ানার চোখে ঘুম নেই। মুখ ব্যথা করছে এখনও ওর, কিনোর বেমক্কা চড় খেয়ে। হুয়ানার কাটা চিবুকের চারপাশে ভনভন করছে ইয়া বড় বড় মাছি।
কয়োটিটোর ঘুম ভাঙতে, ওকে মাটিতে শোয়াল হুয়ানা। হাত-পা ছুঁড়ে খেলা করছে বাচ্চাটা, দুচোখ ভরে দেখছে গর্বিত মা। কয়োটিটো হাসল মার দিকে চেয়ে, পাল্টা হাসল হয়না। বাচ্চার সাথে খানিক খেলা করে, তারপর পানি পান করতে দিল ও।
স্বপ্ন দেখছে কিনো। অস্থিরভাবে নড়চিড়া করে গলা ফাটিয়ে চিৎকার দিয়ে উঠল আচমকা। লড়াইয়ের ভঙ্গিতে দুহাত খুঁড়ছে ও। হঠাৎ উঠে বসল ধড়মড় করে। হাপরের মত ওঠানামা করছে বুক।
উৎকর্ণ হলো কিনো, কিন্তু অরণ্যের গান ছাড়া আর কোন শব্দ বাজল না কানে।
কি হলো? হুয়ানা জানতে চাইল।
চুপ!
স্বপ্ন দেখছিলে তুমি।
হয়তো তাই।
চোখের পাতা আর এক হলো না কিনোর। হুয়ানা ওকে একটা কর্নকেক দিতে, খাওয়া থামিয়ে কান খাড়া করল আবারও। ভয় হচ্ছে কিনোর। কাঁধের ওপর দিয়ে জঙ্গলের দিকে চাইল সে, ছোরাটা শক্ত মুঠোয় ধরল। কয়োটিটো এসময় অস্ফুট শব্দ করে উঠতে কিনো বলল, থামাও ওকে।
কি ব্যাপার গো? হুয়ানা প্রশ্ন করল।
জানি না।
হঠাৎ, কিসের যেন নড়াচড়া দৃষ্টি কাড়ল ওর। কিনো মাথা নামিয়ে গাছের ফাঁক দিয়ে চাইল। লক্ষ্য করল বহু দূরে, তিনজন লোক। দুজন হাঁটছে এবং তৃতীয় লোকটা ঘোড়ার পিঠে। লোকগুলো কাকে খুঁজছে বুঝতে বেগ পেতে হলো না। ধড়াস করে উঠল কিনোর বুকের ভেতরটা।
পায়ে হাঁটছে যে লোক দুটো, তারা গভীর মনোযোগে জমি পরখ করছে। ওদের একজন থমকে দাড়িয়ে ইশারায় কি যেন দেখাল। এরা ট্র্যাকার।
পাথুরে পাহাড়ে ভেড়ার পায়ের ছাপ অনুসরণ করতে পারে এই ট্র্যাকাররা। মাড়ানো, ছেড়া এক টুকরো ঘাসের ডগা, কিংবা বালিতে ক্ষীণতম চিহ্নও ওদের সতর্ক নজর এড়ায় না। শিকারী কুকুরের মত ধূর্ত ওরা। ঘোড়সওয়ার লোকটার নাক কম্বল দিয়ে ঢাকা। হাতে রাইফেল।
গাছের মত ঠায় দাঁড়িয়ে রইল কিনো। শ্বাস বইছে কিনা ওর বোঝার উপায় নেই। যেখানকার ট্রাক মুছে দিয়েছিল, স্বভাবতই চোখ চলে গেল সেখানে। ঝাট দেয়ার চিহ্ন কিছু ফাঁস করে দেবে না তো ট্র্যাকারদের কাছে? এদেরকে চেনে কিনো। পোড় খাওয়া শিকারী ওরা, এখন কিনোকে শিকার করতে এসেছে।
ট্র্যাকাররা হঠাৎ কি একটা দেখে ঝুঁকে পড়ল। অশ্বারোহী স্থির বসে অপেক্ষা করছে। উত্তেজিত কুকুরের মত তর্জন করে উঠল ট্র্যাকার দুজন। ধীরে ধীরে ছোরাটা টেনে বের করে তৈরি হলো কিনো। ইতিকর্তব্য ঠিক করা হয়ে গেছে তার। ওকে ট্র্যাকাররা খুঁজে পেলে, ঘোড়সওয়ারের উদ্দেশে ঝাঁপ দেবে ও। ওই লোকটাকে ঝটপট খুন করে রাইফেলটা ছিনিয়ে নিতে হবে। বাঁচার এই একটাই সুযোগ। লোকগুলো কাছিয়ে আসতে, চোয়াল শক্ত হলো কিনোর।
ঘোড়ার খুরের শব্দ হুয়ানার কানেও গেছে। বাচ্চাটা ডুকরে কেঁদে উঠল এসময়। কয়োটিটোকে শালের নিচে টেনে নিয়ে, ওকে দুধ পান করতে দিল দুয়ানা।
ট্র্যাকাররা কাছিয়ে এল। ওদের আর ঘোড়াটার পা কেবল দেখতে পাচ্ছে কিনো গাছের ফাঁক-ফোকর দিয়ে। এবারে, নোংরা পায়ের সাথে সাথে, পুরানো-জীর্ণ জামা-কাপড়ও চোখে পড়ল।
আরেকটু কাছে এসে থমকে দাঁড়াল ট্র্যাকার দুজন। অশ্বারোহী লোকটাও থেমে দাঁড়িয়েছে। ঘোড়াটা মাথা ওপর-নিচ করে, নাক দিয়ে শ্বাস টানার খোঁৎ জাতীয় জোরাল শব্দ করল।
ট্র্যাকাররা এবার ঘুরে দাঁড়িয়ে জানোয়ারটার দিকে চাইল, ওটার কান লক্ষ্য করছে। ঘোড়াটা বিচিত্র কোন সাড়া-শব্দ পায় কিনা দেখতে চাইছে ওরাI
শ্বাস চেপে স্থাণুবৎ দাঁড়িয়ে কিনো, লড়াই করতে সম্পূর্ণ প্রস্তুত। দীর্ঘক্ষণ রাস্তার ওপর ঝুঁকে বসে রইল ট্র্যাকার দুজন। তারপর সটান উঠে দাঁড়িয়ে আস্তে আস্তে সরে যেতে লাগল। মাটিতে সর্বক্ষণ তীক্ষ্ণ নজর ওদের, অনুগমন করছে অশ্বারোহী। অল্প একটু রাস্তা দৌড়চ্ছে ট্র্যাকাররা, থেমে দাড়িয়ে জমি পরখ করে, তারপর আবার ছুটছে।
ওরা ফিরে আসবে, জানে কিনো। কিনোর ট্র্যাক খুঁজে না পাওয়া অবধি, এভাবেই বিরতি নিয়ে খুঁটিয়ে মাটি পরীক্ষা করবে।
বনের ভেতর ফিরে এল কিনো। ট্র্যাক আড়াল করেনি ও। আসলে, এত বেশি ঝোপ মাড়িয়েছে আর পাথর নড়িয়েছে যে আড়াল করা সম্ভব হয়নি।
কিনো এতটাই ভয় পেয়েছে, ছুটে পালিয়ে যেতে মন চাইছে ওর। আসবে ওরা, যে কোন মুহূর্তে। বউ-বাচ্চাকে নিয়ে এখন যথাসম্ভব দ্রুত দৌড় দেয়া উচিত ওর। হুয়ানার কাছে নিঃসাড়ে এবং ত্বরিত ফেরত এল কিনো। ওকে আসতে দেখে, চোখ তুলে চাইল হুয়ানা।