কয়োটিটো অল্প একটু কেঁদে উঠতে, গান গেয়ে ওকে শান্ত করল হুয়ানা।
আজকের দিনটা ভাল, বলল হুয়ান টমাস। তোদের ট্রাক বাতাসে মুছে যাবে।
চাঁদ ওঠার আগে, রাতের আঁধারে গা ঢাকা দিল কিনো আর হুয়ানা।
হুয়ানা পিঠে বহন করছে কয়োটিটোকে। শালে মোড়ানো বাচ্চাটা, মার কাঁধে এক গাল পেতে, ঘুমিয়ে কাদা। শালের একটা প্রান্ত দিয়ে হুয়ানার নাক ঢাকা, রাতের কনকনে বাতাস থেকে রক্ষা পাচ্ছে এর ফলে।
বিদায়ের আগে কিনোর দুগালে চুমো খেয়েছে হুয়ান টমাস।
অাল্লাহর নামে রওনা দে, বলেছে সে। মুক্তাটা পথে কোথাও ফেলে দিস।
ভাই, মুক্তাটা আমার জীবন-মরণ হয়ে দাড়িয়েছে, জবাবে বলেছে কিনো। ওটা ছুঁড়ে ফেলে দিলে জীবনটাও খোয়াব। ভাল থেকো তোমরা।
তেজী বাতাস খড়-কুটো, বালি আর নুড়িপাথর উড়িয়ে নিয়ে এদিক সেদিক ফেলছে। কিনো আর হুয়ানা মুখ ঢেকে হাঁটছে।
আকাশ ঝকঝকে পরিষ্কার। তারার আলোয় দুনিয়া উদ্ভাসিত।
সাবধানে পা চালাচ্ছে স্বামী-স্ত্রী। শহরে যেতে চায় না ওরা, কারও চোখে পড়তে চায় না। শহরটার পাশ কাটিয়ে উত্তরমুখো ঘুরল দুজনে। বালিময় যে রাস্তাটা ধরে এগোচ্ছে, জঙ্গলের মধ্য দিয়ে গিয়ে পরের শহরটায় মিশেছে সেটা।
দুপায়ে বালির ঝাপ্টা অনুভব করছে কিনো। ওদের পায়ের চিহ্ন মুছে যাবে বালির বুক থেকে, মনে মনে খুশি হয়ে উঠল ও। নক্ষত্রের আলোয়, বনের সরু রাস্তাটা দেখতে পাচ্ছে। কানে আসছে হুয়ানার পায়ের আওয়াজ। কিনো এতটাই হনহনিয়ে হাঁটছে, নাগাল পেতে রীতিমত ছুটতে হচ্ছে হুয়ানাকে।
আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশীদের মত অন্ধকার রাতকে কিনোরও বড় ভয়। শিকারযোগ্য জানোয়ারের দশা এখন কিনোর। দ্রুত আর সতর্কতার সঙ্গে নড়াচড়া করছে সে। গাছ-পালার আর ঝোপ-ঝাড়ের ফাঁকে ফাঁকে বয়ে যাচ্ছে শনশন বাতাস। অজানা আশঙ্কায় বুক কেঁপে ওঠে। আঁধার ভেদ করে হেঁটে চলেছে কিনো আর হুয়ানা।
চাঁদ শেষমেষ ওদের ডান দিকে মাথা তুলল। আলো দেখে স্তব্ধ হলো বাতাস, ফিরে এল গুমোট ভাবটা।
কিনো আর হুয়ানা ছোট্ট একফালি পথটা দেখতে পাচ্ছে সামনে। চাকার দাগ গভীর হয়ে দেবে বসেছে ওটার ওপর। বাতাস থম মেরে গেছে, ফলে ওদের পায়ের ছাপ খুঁজে পেতে কষ্ট হবে না অনুসরণকারীদের।
একটানা সারা রাত হাঁটল ওরা, কোথাও থামল না।
ভোরে, দিনের বেলাটা লুকিয়ে থাকার জন্যে একটা জায়গার খোঁজ করল কিনো। রাস্তার ধারে মিলল তেমনি এক গুপ্তস্থান। ঝোপের মধ্যে কোন এক জানোয়ার গর্ত তৈরি করেছিল। রাস্তা থেকে কারও চোখে পড়ার ভয় নেই। হুয়ানা বসে পড়ে বাচ্চাকে দুধ খাওয়াল, আর কিনো ফিরে গেল রাস্তাটায়। গাছের একটা ডাল ভেঙে নিয়ে, সাবধানে ঝাঁট দিয়ে মুছে দিল ওদের ট্র্যাক।
আলো ফুটছে একটু একটু করে। এ রাস্তা দিয়ে এক মালগাড়ি আসছে, শব্দ পেল কিনো। রাস্তার পাশে ঝোপের আড়ালে উবু হয়ে বসে, দুচাকার ভারী এক মালগাড়িকে পেরিয়ে যেতে দেখল ও। ওটা অতিক্রম করে যাওয়ার পর, রাস্তায় ফিরে এসে মালগাড়ির ট্র্যাক পরখ করে দেখল কিনো। ওর নিজের পায়ের ছাপ মুছে গেছে লক্ষ্য করল। মাটি আরেকবার ঝাঁট দিয়ে হুয়ানার কাছে ফিরে এল ও।
ভাবীর তৈরি করে দেয়া কর্নকেক থেকে কটা স্বামীকে দিল হুয়ানী। তারপর ক্লান্ত শরীরটা এলিয়ে দিল, ওদিকে কিনো বসে রইল পাহারায়।
গনগনে সূর্যটা দেখা দিল এবার। সাগরের ধারেকাছে নেই ওরা, বাতাস ভয়ানক শুকনো আর উত্তপ্ত। গায়ে আগুনের ছ্যাকা লাগছে যেন। গাছগাছালির গন্ধ ভেসে আসছে গরম বাতাসে। সূর্য মাথার ওপর চড়লে সজাগ হলো হুয়ানা। গাছের জটলার দিকে এবার আঙুলের ইশারা করল কিনো।
ওই গাছটার কাছ থেকে সাবধান, বউকে বলল ও। ওটাকে ছুঁয়ো না। এটা স্পর্শ করে চোখে হাত দিলে, অন্ধ হয়ে যাবে।
এরপর আরেকটা গাছ ইঙ্গিতে দেখাল কিনো। ওটার জাল ভেঙো না, বলল। ভাঙলে লাল রক্ত ছুটে আসবে, আর ওই রক্ত দুর্ভাগ্য বয়ে আনবে।
মাথা নেড়ে সামান্য হাসল হুয়ানা। এসব গুরুত্বপূর্ণ তথ্য তারও জানা আছে।
কিনো, ওরা কি আমাদের পিছু নেবে? প্রশ্ন করল হুয়ানা। আমাদের খুঁজে বের করার চেষ্টা করবে?
করবে না আবার, বলল কিনো। আর বাগে পেলে মুক্তাটাও কেড়ে নেবে।
ব্যবসায়ীরা হয়তো ঠিক কথাই বলেছিল, আমতা আমতা করে বলল হুয়ানা। মুক্তাটা কম দামী। আমরা হয়তো ভুলই করেছি।
পকেটে হাত ভরে স্পর্শ নিল কিনো, তারপর বের করে আনল রত্নটা। রোদ পড়ে ঝিক করে উঠল ওটা।
না, বলল কিনো। দামী না হলে চুরি করার চেষ্টা করত না।
কে তোমার ওপর হামলা করেছে বুঝলে কিছু? জানতে চাইল হুয়ানা। ব্যবসায়ীদের কেউ?
কে জানে, জবাব দিল কিনো। দেখতে তো পাইনি।
মুক্তোটার দিকে চোখ রেখে আবারও স্বপ্নে-কল্পনায় বিভোর হলো কিনো। কি কি চাই তার স্বপ্ন দেখতে চেষ্টা করল ও। কিন্তু স্বপ্ন এলে তো। চোখের সামনে শুধু ভেসে উঠছে, মুক্তো পাওয়ার পর থেকে ভয়ঙ্কর যেসব ঘটনা ঘটেছে তার ছবি।
এটা বেচে একটা রাইফেল কিনব, বলল ও।
রাইফেলের ছবি মনের পর্দায় ফোটাতে চাইল কিনো, কিন্তু ভেসে উঠল কেবল মৃত্যুর দৃশ্য। খুন করে এসেছে যাকে, তার মুখখানা কেবল ফুটে উঠছে কল্পনায়।
গির্জায় বিয়ে হবে আমাদের, চট করে বলল কিনো।
বিয়ের কথা ভাবতে গিয়ে, কেবল হুয়ানার ছবি ফুটে উঠছে মানসপটে। হুয়ানার মুখে রক্ত…ও যেখানটায় আঘাত করেছিল।