পড়শীদের ধারণা, কিনো হয়তো সপরিবারে জ্বলন্ত বাসাটার ভেতরে রয়েছে।
০৯. হুয়ান টমাসের বাসাটা
হুয়ান টমাসের বাসাটা প্রায় অবিকল কিনোরটার মতনই। এ পাড়ার বেশিরভাগ বাসাই দেখতে একরকমের। প্রতিটা বাসাতেই ফুটি ফাটা ভরা কিনো আর হুয়ানা দেয়ালের ফুটো দিয়ে আগুনের শিখা দেখতে পাচ্ছে। দাউ দাউ আগুনে ওই যে ধসে পড়ল ওদের বাড়িটার ছাদ।
এবার বন্ধু-বান্ধবদের চেঁচামেচিতে আর হুয়ান টমাসের স্ত্রী, অ্যাপোলোনিয়ার আহাজারিতে ভারী হয়ে উঠল বাতাস। অ্যাপোলোনিয়ার কান্নার কারণ তাদের স্বজন মারা পড়েছে। পরিবারের কেউ মারা গেলে মহিলারা এভাবেই হাহাকার করে থাকে।
আরে, হঠাৎ অ্যাপোলোনিয়ার খেয়াল হলো, সে পুরানো শাল পরে রয়েছে। অমনি সেরা শালটা গায়ে চড়ানোর জন্যে ছুটতে ছুটতে বাড়িতে ঢুকল।
ভাবী দেয়াল লাগোয়া এক বাক্সের দিকে চাইতে, শান্ত-অনুত্তেজিত কণ্ঠে কথা বলে উঠল কিনো।
ভাবী, আমরা এখানে, বলল ও। কান্নাকাটি করে লাভ নেই।
ভূত দেখার মত চমকে উঠল অ্যাপোলোনিয়া। তো-ত্তোমরা? এখানে ঢুকলে কিভাবে?
অত প্রশ্ন কোরো না, বলল কিনো। হুয়ান টমাসকে এখানে ডেকে আনো। আর সাবধান, কেউ যেন না জানে। ব্যাপারটা খুব জরুরী।
কিনোর উদ্দেশে একদৃষ্টে চেয়ে রইল ভাবী। আচ্ছা, বলল শেষমেষ।
কমুহূর্ত পরে স্ত্রীর সঙ্গে বাসায় ফিরল হুয়ান টমাস। একটা মোমবাতি জ্বেলে কোণায় দাঁড়ানো কিনোদের কাছে এল।
অ্যাপোলোনিয়া, বলল হুয়ান টমাস। দরজার কাছে যাও। কেউ যাতে ভেতরে ঢুকতে না পারে।
হুয়ান টমাস শুধু বয়সেই নয়, বুদ্ধিশুদ্ধিতেও কিনোর চাইতে বড়। পরিস্থিতি বুঝে কাজ করার ক্ষমতা রাখে সে।
এখন বল দেখি ঘটনাটা কি?
আঁধারে আমার ওপর হামলা হয়, বলল কিনো। ধস্তাধস্তি করতে গিয়ে একজনকে খুন করে ফেলেছি।
কাকে? চট করে প্রশ্ন করে বড় ভাই।
চিনি না, বলল কিনো। ভীষণ আঁধার ছিল তখন-কিছু ঠাহর হয় না। অবশ্য পরে চাঁদের আলোতেও চিনতে পারিনি।
লোকটা মুক্তার জন্যে এসেছিল, বলল হুয়ান টমাস। মুক্তাটা অপয়া, কিনো। ওটা তোর বেচে দেয়া উচিত ছিল। চাইলে এখনও হয়তো পারবি।
ভাই, বলল কিনো। খুব খারাপ ঘটনা ঘটে গেছে। মৃত্যুর চেয়েও খারাপ। আমার বাড়িটা তো পুড়িয়েছেই, ক্যানুটাও বরবাদ করে দিয়েছে। তার ওপর ঝোপের মধ্যে লাশ পড়ে আছে। আমার ওপর নজর রাখছে শত্রুরা, বাগে পেলেই খতম করে দেবে। তুমি আমাদের লুকিয়ে রাখো, ভাই, আশ্রয় দাও।
তীক্ষ্ণ চোখে ভাইয়ের দিকে চেয়ে থেকে বুঝতে পারল কিনো, হুয়ান টমাস ভয় পাচ্ছে।
বেশিক্ষণ লুকিয়ে রাখতে হবে না, অভয় দিয়ে বলল কিনো।
ভাবিস না, ব্যবস্থা একটা করে ফেলব, হুয়ান টমাস আশ্বাস দিল।
আমি তোমাকে বিপদে ফেলতে চাই না, বলল কিনো। আজ রাতেই গা ঢাকা দেব আমি।
বেশ তো, বলল হুয়ান টমাস, ডাক ছাড়ল স্ত্রীর উদ্দেশে।
অ্যাপোলোনিয়া, দরজাটা লাগিয়ে এখানে এসো। সে এলে বলল, কিনারা এখানে আছে কেউ যেন না জানে।
বাড়িটার অন্ধকার কোণে, সারাটা দিন চুপচাপ বসে থাকল কিনো আর হুয়ানা। পড়শীদের কথা-বার্তা কানে আসছে ওদের। দেয়ালের ফুটো দিয়ে তাদের দেখতেও পাচ্ছে ওরা।
ওদের ভাঙা নৌকাটার বিষয়ে আলোচনা করছে পড়শীরা।
হুয়ান টমাস বাইরে বেরিয়ে গেল প্রতিবেশীদের সাথে কথা বলার জন্যে। কিন্তু তার ভাইয়ের হাতে অচেনা লোকটার হত্যাকাণ্ডের কথা ভুলেও মুখে আনল না।
আমার মনে হয় উপকূল ধরে দক্ষিণে চলে গেছে ওরা, একজনকে উদ্দেশ্য করে বলল হুয়ান টমাস। আরেকজনকে বলল, কিনো সাগর ছেড়ে থাকতে পারবে না। সাগর আমাদের রক্তে। ও হয়তো আরেকটা নৌকা খুঁজে পেয়েছে। এবার আরেকটু জুড়ে দিল ও। বেচারী অ্যাপোলোনিয়া দুঃখে বিছানা নিয়েছে।
সে দিন, সাগরের বুকে আর সাগরপারের ঝোপ-ঝাড়ের ওপর দিয়ে, জোরদার বাতাস বয়ে যাচ্ছিল। কাঠের ছোট ছোট বাসাগুলোও বাতাসের কবল থেকে রেহাই পেল না। আজ সাগরে কোন নৌকাই নিরাপদ নয়।
কিনো তো মারা পড়বে, পড়শীদের একজন বলল। সাগরে যদি নৌকা ভাসিয়ে থাকে।
অন্যরা সায় জানাল তার কথায়।
হুয়ান টমাস পড়শীদের সাথে আলাপ সেরে যতবারই ফেরে, কিছু না কিছু নিয়ে আসে কিনো আর হুয়ানার জন্যে। ছোট্ট এক থলে ভর্তি লাল বিন আর কিছু চাল এনেছে। এক কাপ শুকনো গোলমরিচ আর খানিকটা লবণ, এবং লম্বা, ভারী এক ছোরাও নিয়ে এসেছে।
ছোরাটা দেখে খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠল কিনোর চোখ। ধার পরখ করতে গিয়ে আঙুল কেটেই বসেছিল প্রায়।
বাতাসের দাপটে ঢেউয়ের মাথায় মাথায় সাদা ফেনার মুকুট। ভীতসন্ত্রস্ত জন্তু-জানোয়ারের মত থরথর করে কাপছে গাছ-গাছালি। বেলাভূমি থেকে বালি উড়ে গিয়ে সাগরের ওপর মেঘের মত তৈরি করেছে। বাতাসের ঝাপটায় বৃষ্টির মেঘ উড়ে চলে গেছে কোথায়, আকাশ এখন স্বচ্ছ-নির্মল।
সন্ধে ঘনালে, ভাইয়ের সাথে আলোচনা করল হুয়ান টমাস।
কোথায় যাবি ঠিক করেছিস কিছু?
উত্তরে বলল কিনো। শুনেছি ওদিকে নাকি শহর আছে।
সাগরতীরের ধারে-কাছে ঘেঁষবি না, পরামর্শ দিল হুয়ান টমাস। লোকজন চোখ রাখছে। শহরের লোকেরা তোকে তন্নতন্ন করে খুঁজছে। মুক্তাটা এখনও সঙ্গে আছে?
আছে, জবাব দিল কিনো। ওটা হাতছাড়া করব না। চোখের দৃষ্টি ওর কঠোর আর নিষ্ঠুর হয়ে গেছে।