পাচ্ছি, ক্লান্তি ফুটল কিনোর কণ্ঠে।
ওগো, আকুল কণ্ঠে বলল হুয়ানা। মুক্তাটা অপয়া। এসো, আমরা ওটাকে ধ্বংস করে দিই, নইলে ওটাই আমাদের ধ্বংস করবে! পাথর দিয়ে ভেঙে দুটুকরো করে দিই এসো। আর না হয় সাগরে ছুঁড়ে ফেলে দিই চলো! কিনো, মুক্তাটা অলক্ষুণে, অপয়া!
হুয়ানা যখন এসব বলছে, আলো ফিরল কিনোর চোখে। ধকধক করে জ্বলছে চোখজোড়া, মুখখানা কঠোর হয়ে উঠেছে।
না, দৃঢ় কণ্ঠে ঘোষণা দিল ও। আমি শেষপর্যন্ত লড়াই করব। দেখো, আমিই জিতব! ভাগ্যলক্ষ্মীকে এভাবে পায়ে ঠেলতে পারি না আমরা।
দুম করে মাদুরের ওপর কিল মারল কিনো। কেউ আমাদের সৌভাগ্য ছিনিয়ে নিতে পারবে না।
হুয়ানার দিকে চাইল কিনো। রাগ অনেকটা পড়ে এসেছে ওর। হাত রাখল বউয়ের কাঁধে।
বিশ্বাস করো, বলল ও, আমি সাহসী পুরুষমানুষ। সকালবেলা, ক্যানু নিয়ে আমরা সাগরে ভেসে পড়ব, তারপর পায়ে হেঁটে হোক, যেভাবে হোক পাহাড়-পর্বত ডিঙিয়ে রাজধানীতে গিয়ে হাজির হব। তুমি থাকবে আমার সাথে। অমিদের কেউ ঠকাতে পারবে না দেখে নিয়ো।
ওগো, অবসাদগ্রস্ত কণ্ঠে বলল হুয়ানা। আমার ভয় করছে। বীরপুরুষরাও তো মারা পড়ে। তারচেয়ে চলো, সাগরের জিনিস সাগরে ফেলে দিই।
তারপর চুপ করে গেল হুয়ানা।
একটু ঘুমিয়ে নাও, বলল কিনো। আলো ফুটলেই রওনা দেব আমরা। তুমি ভয় পাচ্ছি আমার সাথে যাওয়ার কথা শুনে?
না তো, জবাব দিল হুয়ানা। হুয়ানার গালে কিনোর হাতের আলতো, উষ্ণ ছোঁয়া লাগল।
একটু ঘুমিয়ে নেয়া যাক, নরম সুরে বলল ও।
০৮. আঁধারে চোখ মেলে চাইল কিনো
আঁধারে চোখ মেলে চাইল কিনো। কাছেই কিসের যেন নড়াচড়া টের পেল, কিন্তু স্থির রইল ও, একচুল নড়ল না। আঁধার ভেদ করে দেখার চেষ্টা করছে। ছোট্ট বাসাটার খুদে গর্তগুলো দিয়ে চুইয়ে ঢুকেছে চাঁদের আলো।
চাঁদের বিভায়, হুয়ানা আলগোছে উঠে পড়ছে মাদুর ছেড়ে লক্ষ্য করল কিনো। চুলোর উদ্দেশে ওকে যেতে দেখল সে। হুয়ানা পাথরটা সরাতে মৃদু একটু শব্দ হলো। এবার সে নিঃশব্দে দরজার দিকে যাচ্ছে। মুহূর্তের জন্যে থমকে দাঁড়িয়ে, ঝুকে পড়ল কয়েটিটোর দোলনার ওপর। এবার পা টিপে বেরিয়ে গেল ঘর ছেড়ে। কিনো ভয়ানক রেগে গেছে। ধড়মড় করে উঠে পড়ে অনুসরণ করল হুয়ানাকে। সাগরের উদ্দেশে হুয়ানার চলমান পদশব্দ নিস্তব্ধ রাতে স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে কিনা।
অনুগমনরত কিনোর মাথায় আগুন ধরে গেল।
ঝোপ-ঝাড়ের মধ্য দিয়ে এঁকেবেঁকে, পাথর মাড়িয়ে অবিচল এগিয়ে চলেছে হুয়ানা।
হঠাৎ করে কিনোর অশুয়ান পায়ের আওয়াজ পেয়ে, পড়ি কি মরি করে দৌড় দিল সে।
হাত শূন্যে, মুক্তোটা এক্ষুণি ছুঁড়ে ফেলে দেবে সাগরের জলে। কিনো ঝাপিয়ে পড়ে শক্ত করে চেপে ধরল হাতটা, তারপর মোচড় মেরে কেড়ে নিল মুক্তোটা।
চটাস করে এক চড় পড়ল হুয়ানার গালে। পাথরের ওপর সে মুখ থুবড়ে পড়ে যেতে, কষে এক লাথি মারল কিনো। চাঁদের উদ্ভাসিত আলোয়, ছোট ছোট ঢেউ বয়ে যাচ্ছে হুয়ানার দেহের ওপর দিয়ে, লক্ষ্য করল কিনে। পানিতে, হুয়ানার পায়ের কাছে ফুলে ভেসে উঠছে স্কার্টটা।
কিনো নিচের দিকে চেয়ে হিংস্র কুকুরের মতন দাঁত খিচাল। বিস্ফারিত, আতঙ্কিত চোখ তুলে চাইল হুয়ানা। কসাইয়ের সামনে দাঁড়ানো ভেড়ার মত লাগছে ওর নিজেকে। কিনো ওকে এখন মেরে ফেলতে চাইলেও ঠেকাতে পারবে না। মৃত্যুর জন্যে অপেক্ষা করছে হুয়ানা। একটু পরে হুঁশ ফিরে পেল যেন কিনো। হুয়ানা কি করতে যাচ্ছিল ভেবে দুর্বল হয়ে পড়ল। ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা-ভাবনা করতে পারছে না ও। ঘুরে দাঁড়িয়ে টলতে টলতে ঝোপের মধ্যে দিয়ে ফিরে চলল।
হঠাৎ, শুনতে পেল কে যেন ছুটে আসছে ওর দিকে। আতঙ্কিত কিনো ঘুরে দাঁড়াল। ছোরাটা বের করে চালিয়ে দিতে, ওটা ঘ্যাঁচ করে গেঁথে গেল প্রতিপক্ষের দেহে। আর্তনাদ ছেড়ে এবার কে যেন টান মেরে মাটিতে ফেলে দিল ওকে, পকেট হাতড়াচ্ছে ওর লোভীর মত। মুক্তোটা ধস্তাধস্তির ফলে, ছোট্ট পাথুরে পথটার ওপর গড়িয়ে পড়ল। চাঁদের আলোয় ঝিকোচ্ছে ওটা।
ওদিকে পানিতে পড়ে রয়েছে হুয়ানা। মুখ আর শরীরের একটা পাশে ভয়ানক যন্ত্রণা হচ্ছে তার। কোনমতে হাঁটুতে ভর দিয়ে বসল। কিনোর ওপর রাগ হচ্ছে না ওর। কিনোকে হুয়ানার প্রয়োজন, ওকে ছাড়া বাঁচবে না সে। কিনোকে অতখানি বোঝে না, কিন্তু এটা জানে লোকটাকে ভালবাসে সে। কিনোকে অনুসরণ করবে ও। হয়তো বাঁচাতে পারবে কিনোকে এই অভিশপ্ত মুক্তোটার হাত থেকে।
সাগরের পানিতে মুখ ধুয়ে, ধীরে সুস্থে উঠে দাঁড়াল হয়না। তীর ধরে শ্লথ পায়ে কিনোর খোজে চলল। দক্ষিণ দিক থেকে ভেসে এসেছে কয়েক খন্ড মেঘ। তাদের ফাঁক-ফোকর গলে মাঝেমধ্যে উঁকি দিচ্ছে চাঁদ। কাজেই আলো আঁধারির মধ্যে হাঁটতে হচ্ছে হুয়ানাকে। পিঠটা ভেঙে পড়ছে ব্যথায়, নুয়ে পড়েছে মাথা। ঝোপ-ঝাড়ের মধ্য দিয়ে যখন এগোচ্ছে চাদঁ তখন মেঘে ঢাকা। আলো ফুটলে, পাথুরে পথটার ওপর ঝকমক করতে দেখল ও মস্তবড় মুক্তোটাকে। হাঁটু গেড়ে বসে ওটা তুলে নিল হুয়ানা।
এক টুকরো মেঘের আড়াল নিল আবার চাঁদ। হাঁটুতে ভর দিয়ে বসে হুয়ানা ভাবছে, আবারও সাগরে ফিরে যাবে কিনা। মেঘের ওপাশ থেকে চাঁদ ফুড়ে বেরোতে, হুয়ানা লক্ষ্য করল, ওর সামনে পায়ে চলা পথটার ওপর দুজন পুরুষ লোক পড়ে রয়েছে। তড়াক করে লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল হুয়ানা। কিনো না ওটা? অপর লোকটা অপরিচিত। গলা বেয়ে রক্তের নদী বইছে তার।