এখান থেকে রাজধানীর তাও প্রায় একহাজার মাইলের দূরত্ব; সাগর পাড়ি দিয়ে, পাহাড়ী পথ ধরে, পৌঁছতে হবে সেখানে। প্রতি মাইল পথ অপরিচিত আর বিপদসঙ্কুল। কিন্তু কিনো অনুভব করছে, পুরানো দুনিয়াকে পেছনে ফেলে ওকে নতুন জীবনের সন্ধানে যেতেই হবে। ওর ভবিষ্যৎ-স্বপ্ন নিছক কল্পনা হয়ে থাকবে, ভাবতেই পারে না কিনো।
আমি যাব, ঘোষণা করল ও।
হুয়ানা একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল স্বামীর দিকে। একটু পরে সংবিৎ ফিরে পেয়ে, ছেলেকে গোসল করাল। তারপর তাকে খাইয়ে-দাইয়ে, বেশ কিছু কর্নকেক বানাল রাতের জন্যে।
ইতোমধ্যে হুয়ান টমাস এসে কিনোর পাশে বসেছে। দীর্ঘক্ষণ টু শব্দটি করল না কিনোর ভাই। অবশেষে মুখ খুলল কিনা।
আর কি করার ছিল আমার? বলে উঠল ও। সব ব্যাটা বাটপাড়!
ধীরে ধীরে মাথা নাড়ে হুয়ান টমাস। কিনোর চাইতে বয়সে বড় সে, অভিজ্ঞ। কিনো বড়ভাইয়ের মতামত জানতে সাগ্রহে অপেক্ষা করছে।
আমার জানা নেই, বলল হুয়ান টমাস। শুধু এটুকু জানি, সারা জীবন লোকে আমাদের ঠকিয়ে খাচ্ছে, তবু তো বেঁচে আছি। তুই ওদের কাছে মুক্তা বেচলি না। তুই চাইছিস গোটা সমাজ বদলে দিবি। তোর জন্যে আমার ভয় হয়।
খিদের কষ্ট ছাড়া আর কোন কিছুকে ভয় কি আমার? জবাব চায় কিনে। কিন্তু বড়ভাই দুপাশে মাথা নাড়ে আস্তে আস্তে।
সবারই তো পেটের চিন্তা, বলল হুয়ান টমাস। কিন্তু ধর, তোর মুক্তাটা যদি অনেক দামীও হয়, তুই কি মনে করিস ন্যায্য দাম পাবি?
মানে? কি বলতে চাইছ তুমি?
আমি নিজেও জানি না, মৃদু স্বরে বলে হুয়ান টমাস। কিন্তু তোর জন্যে আমার ভয় করছে। নতুন দুনিয়ায় পা রাখতে যাচ্ছিস তুই, অথচ রাস্তা চিনিস না।
আমি যাচ্ছি। শিগগিরিই যাচ্ছি।
হ্যাঁ, বলল হুয়ান টমাস। তা যা, কিন্তু তোর কি ধারণা, রাজধানী শহরে সব ফেরেশতারা বসে আছে? এখানে, এই শহরে, তোর বন্ধু-বান্ধব আছে, আমি আছি। কিন্তু রাজধানীতে কে আছে, বল?
কিন্তু আমি কি করব তুমিই বলো, বলল কিনো। ব্যবসায়ীরা আমাদের চিরটাকাল ঠকিয়েছে। আমার ছেলেটাকে তো একটা সুযোগ দিতে হবে। ওরা আমার বাচ্চাটাকেও ঠকিয়ে খেতে চাইছে। বন্ধুরা আমার পাশে থাকবে।
থাকবে, যতক্ষণ না নিজেদের ওপর বিপদ আসে, বলল হুয়ান টমাস। এবার সটান উঠে দাঁড়িয়ে যোগ করল, খোদাকে ভুলিস না, তিনি তোর সাথে থাকবেন।
মাথা নিচু করে বসে রইল কিনো। ভাইয়ের কথাগুলো বড় শীতল শুনিয়েছে ওর কানে।
হুয়ান টমাস চলে গেছে অনেকক্ষণ, মাদুরে বসে এখনও সাত-পাঁচ ভেবে চলেছে কিনো। ক্লান্তি অনুভব করছে সে, বোধ করছে হতাশা। ইতিকর্তব্য ঠিক করতে পারছে না। সন্ধ্যা রাতের নানা অস্কুট শব্দ বাজছে ওর কানে।
কিনোর উদ্দেশে চাইল হুয়ানা। বুঝতে পারছে মেয়েটি, এমুহূর্তে কিনোকে নীরবে সঙ্গ দিলেই তার সবচেয়ে বেশি উপকার করা হবে। ভয় পাচ্ছে ও, তাই কয়েটিটোকে বুকে চেপে ধরে বিপদনাশী এক গান ধরল।
কিনোর মধ্যে নড়াচড়া লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। হুয়ানার জানা আছে, খিদে পেলে নিজেই খাবার চাইবে ওর স্বামী।
কিনোর চোখের দৃষ্টি স্থির-অবিচল। বাসার বাইরে কিসের যেন শব্দ হলো মনে হলো ওর। বাইরে অশুভ কিছু যেন ওঁত পেতে রয়েছে ওর জন্যে। কৃষ্ণবর্ণ, অভিশপ্ত জিনিসটা ওকে যেন ঘরের বাইরে টেনে বের করে, লড়াই করতে আহ্বান জানাচ্ছে। সড়াৎ করে ডান হাতটা শার্টের ভেতর চলে গেল কিনোর। ছোরাটা জায়গা মতই আছে। চোখজোড়া বিস্ফারিত ওর। সিধে উঠে দাঁড়িয়ে দরজার উদ্দেশে এগিয়ে গেল ও।
স্বামীকে ফেরাতে চেষ্টা করল হুয়ানা। একটা হাত তুলেছিল, কথা বলার জন্যে হাঁ হয়ে গিয়েছিল ওর মুখ।
অন্ধকারের দিকে দীর্ঘক্ষণ চেয়ে থেকে, তারপর বেরিয়ে এল কিনো। হুয়ানা শুনতে পেল, বাতাসে কি যেন একটা সাঁ করে উড়ে এসে আঘাত হানল কিনোকে। মুহূর্তের জন্যে ভয়ে হাত-পা পেটের ভেতর সেঁধিয়ে গেল হুয়ানার। পরমুহূর্তে বুনো বেড়ালীর মতন দাঁত বেরিয়ে পড়ল ওর
আক্রমণের ভঙ্গিতে।
কায়েটিটোকে আলগোছে মেঝেতে শুইয়ে দিয়ে, চুলোর ধার থেকে একখণ্ড পাথর তুলে নিল হুয়ানা। তারপর ছুটে বেরিয়ে গেল বাইরে।
মাটিতে পড়ে রয়েছে কিনো।
আশপাশে কাউকে চোখে পড়ল না হুয়ানার। বাতাসের আর ঢেউয়ে শব্দ ছাড়া চারদিক সুনসান। কিন্তু টের পেল ও, কেউ একজন ছিল ধারেকাছে-কাঠের বেড়ার ওপাশে কিংবা বাড়ির আবছায়ায় ঘাপটি মেরে।
পাথরটা ফেলে দিয়ে দুহাতে স্বামীকে জড়িয়ে ধরল হুয়ানা। তাকে উঠে দাঁড়িয়ে বাসায় হেঁটে যেতে সাহায্য করল। কিনোর মুখ বেয়ে দরদর করে রক্ত গড়াচ্ছে। কান থেকে চিবুক অবধি ওর বিশ্রীভাবে কেটে গেছে। এপাশওপাশ মাথা দোলাল কিনো। ওর জামা-কাপড় ছিড়ে গেছে জায়গায় জায়গায়। মাদুরে বসিয়ে, হুয়ানা কিনার মুখ থেকে রক্ত মুছিয়ে দিল ওর স্কার্ট দিয়ে। কিনোর জন্যে এরপর খানিকটা পানি নিয়ে এল, কিন্তু দুপাশে তখনও মাথা নেড়ে যাচ্ছে ওর স্বামী।
কে ছিল ওটা? শুধাল হয়না।
জানি না, বলে কিনো। দেখতে পাইনি।
কিনোর মুখের জখম পানি দিয়ে ধুয়ে পরিষ্কার করে দিল হুয়ানা। কিনো সামনে ফাঁকা দৃষ্টিতে চেয়ে বসে রইল।
কিনো, স্বামী আমার, বলে উঠল হুয়ানা, কিন্তু কিনোর দৃষ্টি যেমনকে তেমন রইল। আমার কথা শুনতে পাচ্ছি তুমি?