যা তো, গর্জে উঠল লোকটা। আর সব ব্যবসায়ীদের এখানে ডেকে নিয়ে আয়। কেন ডেকেছি বলবি না। শুধু বলবি তারা এলে আমি খুশি হব।
মোটা ব্যবসায়ী ডেস্কের নিচে হাত নিয়ে, তার প্রিয় মুদ্রার খেলাটা আবারও চালু করল।
কিনোর প্রতিবেশীরা পরস্পরের সঙ্গে মৃদু সুরে আলোচনা করছে। মুক্তোটায় কোন খুঁত রয়েছে মনে করে ভয় পাচ্ছে তারা। মুক্তোটা বিরাট কোন সন্দেহ নেই, কিন্তু এর রঙটাও তো কেমন অদ্ভুত কিসিমের। রংটার কথা, কিনো ওটা খুঁজে পাওয়ার পর থেকেই মাথায় আছে পড়শীদের। এক হাজার পেসো মন্দ কি? যার কিছুই নেই তার জন্যে এক হাজার পেসে তো অনেক। কিনো মেনে নিলেই তো তার পকেটে চলে আসছে এতগুলো টাকা। গতকাল পর্যন্ত যেখানে তার কিছুই ছিল না।
কিন্তু কিনোর মুখখানা কঠোর, চোয়াল শক্ত। চারপাশে ওর বুনো জন্তুজানোয়ার এমনি অনুভূতি হচ্ছে। প্রতিকূল পরিবেশে নিজেকে বড় অসহায় বোধ হচ্ছে ওর। আশ্চর্য সুন্দর মুক্তোটা দ্যুতি ছড়াচ্ছে কালো কাপড়ের ওপর এবং ব্যবসায়ী লোকটা সেদিক থেকে দৃষ্টি ফেরাতে পারছে না।
দরজায় দাঁড়ানো লোকজন সরে, অপর তিন ব্যবসায়ীকে অফিসটিতে প্রবেশ করতে দিল। জনতা এমুহূর্তে থম মেরে গেছে। ঘটনা স্বচক্ষে অবলোকন করতে চায় তারা, যা কথাবার্তা হবে শুনতে চায়। কিনো নিশ্চুপ এবং সতর্ক। কে যেন জামা ধরে টানছে টের পেয়ে ঘুরে চাইল। হুয়ানার সাথে চোখাচোখি হয়ে গেল ওর। চোখ ফেরানোর পর মনোবল ফিরে পেল সে।
সওদাগরের একে অন্যের দিকে ভুলেও তাকাচ্ছে না। এমনকি মুক্তোটার অস্তিত্ব সম্পর্কেও যেন কিছু জানে না তারা। মোটা লোকটা অবশেষে নীরবতা ভঙ্গ করল।
আমি এ লোককে তার মুক্তোর জন্যে একটা দাম বলেছি, বলল সে। কিন্তু ওর মনে হচ্ছে আমি ন্যায্য দাম বলিনি। আপনারা যদি এটা-এই মুক্তোটা-দেখে একটু দামটা বলতেন তবে ও একটা ধারণা পেত।
শুনলে তো, কিনেকে উদ্দেশ্য করে বলল মোটকু। আমি কত বলেছি ওদের জানাইনি।
প্রথম ক্রেতা বেঁটে মতন রোগাটে এক লোক। মুক্তোটা দুমুহূর্ত লক্ষ্য করে দুআঙুলে তুলে নিল সে। তারপর কালো কাপড়টার ওপর ছুঁড়ে দিল।
তাই দেখে হৃৎপিণ্ডটা গলার কাছে উঠে এল কিনোর।
আমি এটার জন্যে এক পয়সাও দিতে রাজি নই, ঘোষণা করল সে। মাগনা দিলেও নেব না। এটা আসল মুক্তো নয়!
দ্বিতীয় বণিক নম্রভাষী বেঁটে খাটো মানুষ। মুক্তোটা হাতে নিয়ে সাবধানে পরখ করে দেখল। পকেট থেকে একটা কাঁচ বের করে আবারও যাচাই করল। তারপর গলার ভেতর হেসে উঠল।
সেরা মুক্তো প্লাস্টারে তৈরি হয়, বলল সে। আমি এগুলো ভাল করেই জানি। এই মুক্তোটা নরম, কয়েক মাসের মধ্যেই রঙ চটে যাবে। দেখুন।
কিনোকে কাঁচটা দিল সে। কাঁচ ভেদ করে কোনদিন মুক্তো দেখেনি কিনো। মুক্তোটা বড় অদ্ভুত দেখাল ওর চোখে।
তৃতীয় ব্যবসায়ী কিনোর হাত থেকে মুক্তোটা নিল।
আমি একজনকে চিনি যার এধরনের জিনিস পছন্দ, বলল লোকটা। আমি পাঁচশো পেসো দিতে পারি। হয়তো একশো লাভ থাকবে।
লোকটার হাত থেকে মুক্তোটা প্রায় ছিনিয়ে নিল কিনো। চামড়ায় ভরে রেখে দিল ওটা ছোট থলেটার ভেতর। তাই দেখে ডেস্কের পেছনে বসে থাকা মোটা ব্যবসায়ীর মুখে কথা ফুটল।
লোকে আমাকে গাধা ভাবতে পারে, বলল সে, কিন্তু তারপরও একহাজার পর্যন্ত দিতে পারি আমি।
থলেটা পকেটে চালান করে দিল কিনো।
করে কি? হাহাকার করে ওঠে মোটা।
আপনারা আমাকে ঠকাচ্ছেন! ক্ষুদ্ধ কিনো বলে। মুক্তা আমি এখানে বেচব না। রাজধানীতে নিয়ে যাব।
চকিতে পরস্পর চোখাচোখি হলো ব্যবসায়ীদের। বেশি কম বলে ফেলেছে বুঝতে পারছে ওরা। মুক্তোটা হাতাতে না পারলে বড় ব্যবসায়ী খেপে বোম হয়ে যাবে, তখন তাকে সামলাবে কে? ডেস্কে বসা মোটা কথা বলল আবার।
পনেরোশো পর্যন্ত ওঠা যায়, বলল সে।
কিন্তু কিনো তখন জনতার ভিড় ঠেলে বেরিয়ে যাচ্ছে। ক্রুদ্ধ কিনো যখন হনহনিয়ে হাঁটা দিল, তার কানে তখন রক্তের উত্তাল প্রবাহ।
পেছন পেছন ছুটতে হলো হুয়ানাকে, স্বামীর নাগাল পেতে।
০৭. সাঁঝ ঘনালে
সাঁঝ ঘনালে, পড়শীরা তাদের ঘরে, সেদিনের ঘটনাগুলো নিয়ে আলোচনা করতে বসল। ওরা কেউ আগে কোনদিন এত সুন্দর মুক্তো চোখে দেখেনি। তাদের সবার ধারণা, কিনোর মুক্তোটা যেমন শোভাময় তেমনি দামী। কিন্তু ক্রেতারা একমত হয়নি ওদের সাথে। এবং তারা মুক্তোর দর-দাম ওদের চাইতে ভাল বোঝে।
ওরা মুক্তার ব্যাপারে কেউ কারও সাথে কথা বলেনি, বলাবলি করে প্রতিবেশীরা। সবাই বলল মুক্তাটা কম দামী।
আগেভাগেই ওরা আলাপ সেরে রাখেনি তো? একজনের মনে প্রশ্নের উদয় হয়।
তাহলে তো বলতে হয়, অন্যরা জবাব দেয়। সারা জীবনভর আমাদের ঠকিয়ে যাচ্ছে ওরা।
কারও কারও মতে কিনোর উচিত ছিল, পনেরোশো পেসো হাত পেতে নেয়া। এত টাকা জন্মে কোনদিন দেখেনি সে। বোকামিই করল হয়তো। রাজধানী শহরে গিয়ে হয়তো কোন ক্রেতা পেলই না, কে বলতে পারে। তখন আর শহরের ব্যবসায়ীরা ওকে আগের দাম দেবে না।
আবার অন্যদের ধারণা, কিনো বলিষ্ঠ এবং সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
ওর সাহসের কারণে আমরা সবাই সুফল ভোগ করব, বলে তারা। কিনোর জন্যে গর্ববোধ হচ্ছে তাদের।
নিজের ছোট্ট বাসাটায়, মাদুরে বসে বসে আকাশ-পাতাল ভাবছে কিনো। চুলোর কাছে; এক পাথরের নিচে লুকিয়ে রেখেছে ও মুক্তোটা। ভয়ভয় ভাবটা আবারও গ্রাস করছে ওকে। বাড়ি ছেড়ে অাজ অবধি দূরে কোথাও যায়নি সে। অচেনা মানুষ-জন, বিদেশ-বিভুই চিরদিনই আতঙ্কিত করে ওকে। বিশেষ করে, রাজধানী শহরটাকে ওর বড় ভয়, কখনও যায়নি তো।