শহরমুখী জনতার স্রোত এমুহূর্তে নীরব। দিনটার ভাবগাম্ভীর্য রক্ষা করছে তারা। বাচ্চা-কাচ্চাদের সামলে রাখা হচ্ছে। চেঁচামেচি কিংবা খেলাধুলা করতে গেলেই ধমক জুটছে কপালে। এমন এক মহান দিবসের সাক্ষী হওয়ার জন্যে, এক বৃদ্ধ তার ভাতিজার কাঁধে সওয়ার হয়ে সবার সঙ্গে চলেছে।
কাঠের বাসাগুলো পেছনে ফেলে সারবন্দী জনতা শহরে এসে পৌঁছল। শহরে, রাস্তাগুলো খানিকটা চওড়া আর বাড়ি-ঘরের পাশে সরু সরু ফুটপাথ। ভিখিরির দল যথারীতি, শহরাগতদের লক্ষ্য করে পিছু নিল। খদ্দেররা দৌড়ে শোভাযাত্রায় মিশে যেতে বাধ্য হয়ে ঝাঁপ ফেলতে হলো দোকানিদের। রাস্তায় প্রতিফলিত হচ্ছে সূর্যচ্ছটা। এমনকি একরত্তি নুড়িগুলো অবধি ছায়া ফেলছে মাটিতে।
মুক্তো ব্যবসায়ীদের ঘুপচি অফিসে আলো আঁধারি পরিবেশ, মিছিলের খবর পৌঁছে গেল সেখানে।
ওদের অফিসের ছোট ছোট জানালায় গরাদ দেয়া, ফলে ভেতরটায় আবছায়া। কিনোর জন্যে প্রস্তুত হলো ব্যবসায়ীরা। ডেস্কে তড়িঘড়ি করে কাগজপত্র নামিয়ে রাখল তারা, কিনো এলে যাতে ব্যস্ত দেখে তাদের। নিজেদের মুক্তো সরিয়ে রাখল লোকগুলো, ছোট মুক্তোর পাশে বড় মুক্তো আরও বেশি মূল্যবান দেখাবে কিনা তাই। সবার জানা হয়ে গেছে কিনোর মুক্তোটার আকৃতি।
হোঁতকা এক লোক তার অফিসে বসে অপেক্ষা করছে। লোকটার মুখের চেহারায় সহৃয় ও বন্ধুভাবাপন্ন অভিব্যক্তি। এ লোক সবাইকে শুভ সকাল! বলে অভিবাদন জানায়। লোকের হাত ঝাঁকিয়ে দিয়ে মজার মজার কথা বলে। কিন্তু হলে হবে কি, অাদতে লোক সে সুবিধের নয় অসৎ।
আজ সকালে, ফুলদানিতে ফুল রেখেছে লোকটা। তার ডেস্কে রাখা কালো কাপড়টার পাশে ফুলদানিটা স্থান পেয়েছে। সযত্নে দাড়ি কামিয়েছে সে, হাত দুটো আচ্ছা মতন ধুয়ে ফর্সা বানিয়েছে।
অফিসের দরজা খুলে রেখেছে সে, গানের সুর ভাঁজছে গুনগুন করে, আর একটা মুদ্রা নিয়ে খেলা করছে আনমনে। দুআঙুলের মাঝে মুদ্রাটা নাড়াচাড়া করছে, দরজার বাইরে দৃষ্টি চলে গেল তার। আগুয়ান পায়ের আওয়াজ কানে আসছে। কিনো দরজা দিয়ে কামরায় প্রবেশ করতে, লোকটা ডেস্কের নিচে চট করে চালান করে দিল মুদ্রাটা।
শুভ সকাল, বন্ধু আমার, বলল মোটা লোকটা। আমি তোমার জন্যে কি করতে পারি?
উজ্জ্বল রোদ থেকে এইমাত্র আধো অন্ধকারে প্রবেশ করেছে কিনো, ঘরের ভেতরটা পরিষ্কার দৃষ্টিগোচর হলো না তার। ক্রেতা লোকটির মুখে মৃদু হাসি লেগে রয়েছে, কিন্তু চোখজোড়া কঠোর হয়ে উঠেছে। ডেস্কের নিচে, তার বাঁ হাত মুদ্রাটা নিয়ে তখনও খেলা করে চলেছে।
একটা মুক্তা এনেছিলাম, বলল কিনে।
হুয়ান টমাস কিনোর পাশে দাঁড়ানো। পড়শীরা দরজায় গাদাগাদি করে দাঁড়িয়ে কি হয় উৎসুক দৃষ্টিতে লক্ষ্য করছে। কিনোর পায়ের ফাঁক দিয়ে মজা দেখছে কয়েকটা শিশু-কিশোর।
একটা মুক্তো এনেছ, বলল ব্যবসায়ী, অনেকে তো এক ডজন আনে। দেখি, কি এনেছ। মনে ধরলে ন্যায্য দামই পাবে, ঠকাব না।
ডেঞ্চের নিচে মুদ্রার খেলা দ্রুততর হলো।
আস্তে আস্তে চামড়ার থলেটা বের করল কিনো, ওটা থেকে ধীরে ধীরে তুলে নিল পশুর নরম চামড়ার টুকরোটা। কিনো এবারে ডেস্কের কালো কাপড়টার ওপর সযত্নে নামিয়ে রাখল রত্নটা। মোটা ব্যবসায়ীর মুখের ওপর দৃষ্টি স্থির ওর। মুখের চেহারার ভাব এতটুকু পরিবর্তন হলো না লোকটার, কিন্তু ডেস্কের তলায় আঙুল ফস্কে গেল মুদ্রাটা; নিঃশব্দে পড়ে গেল মেঝেতে। লোকটার ডান হাত এবার কালো কাপড়ে রাখা মুক্তোটা স্পর্শ করল। দুআঙুলে রত্নটা তুলে নিয়ে কাছ থেকে পরখ করছে সে।
শ্বাস চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে কিনো ও তার সঙ্গীদের। অন্যান্য দর্শকরা অনুচ্চস্বরে কথাবার্তা বলছে।
মুক্তাটা যাচাই করছে, বলাবলি করছে তারা। এখনও দাম বলেনি। ওদের মধ্যে দর-দাম হয়নি এখনও।
কালো কাপড়ের ওপর মুক্তোটা রেখে দিল ব্যবসায়ী। তর্জনী দিয়ে ওটায় চাপ দিয়ে বিষণ্ণ হাসি ফুটিয়ে তুলল মুখে।
আমি দুঃখিত, বন্ধু, বলে, কাঁধ ঝাঁকাল সামান্য, বোঝাতে চাইল তার কিছু করার নেই।
খুব দামী মুক্তা, বলল কিনা।
ব্যবসায়ী আঙুলে নাড়াচাড়া করছে রত্নটা, ফলে ওটা কাপড়ের একপ্রান্ত থেকে আরেকপ্রান্তে গড়াগড়ি খাচ্ছে।
এই মুক্তোটা অতিরিক্ত বড়, বলল লোকটা। কে কিনবে এটা? কেউ কিনবে না। আমি দুঃখিত।
কিনো ওর কথার মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারছে না।
এটা দুনিয়ার সেরা মুক্তা! বলে উঠল সে। এ জিনিস কেউ চোখেও দেখিনি!
মুক্তোটা বড়, দেখতেও সুন্দর, কিন্তু দাম পাবেন না, বলল ব্যবসায়ী। আমি বড়জোর একহাজার পেসো দিতে পারি।
কিনোর মুখখানা কালো আর হিংস্র হয়ে উঠল।
পঞ্চাশ হাজারেও এ জিনিস পাবে না, বলে উঠল। কথাটা আপনি নিজেও জানেন, কিন্তু আমাকে ঠকানোর জন্যে মিথ্যে কথা বলছেন!
ওর সাধা দাম শুনে লোকে নানা কথা বলছে শুনতে পেল ব্যবসায়ী। খানিকটা ভয় পেয়ে গেল সে।
যাও না, অন্যদের কাছেও যাচাই করে দেখো না, চট করে বলল হোঁদল কুতকুত। আমার কথাই শুনতে হবে এমন মাথার দিব্যি কে দিয়েছে। আরও তো অফিস আছে, তাদের কাছে যাও। কিংবা চাইলে তাদের এখানে নিয়ে আসতে পারো। তাহলেই বুঝতে পারবে আমরা ঘোঁট পাকিয়েছি কিনা। অ্যাই, ছোড়া!
পেছনের দরজা দিয়ে উঁকি দিল লোকটার ভৃত্য।