মুক্তোটার দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে, চোখ থেকে ক্রোধের দৃষ্টি মুছে গেল ওর, সারা মুখে ছড়িয়ে পড়ল আশ্চর্য এক স্নিগ্ধতা। হুয়ানা স্বামীর দিকে চাইতে তার মুখে হাসি লক্ষ্য করল। হাসি ফুটল হুয়ানার মুখেও। বুক ভরা আশা নিয়ে নতুন দিনটা শুরু করল ওরা।
০৬. ভোরে কিনো মুক্তো বেচতে যাবে
সবাই জানে, ভোরে কিনো মুক্তো বেচতে যাবে। গোটা শহরে উত্তেজনা। গির্জার ভিখিরি থেকে শুরু করে মুক্তো ব্যবসায়ীরা পর্যন্ত সবাই উত্তেজিত। মুক্তো ব্যবসায়ীরা যার যার অফিসে একাকী বসে রয়েছে, তারা প্রত্যেকে ছোট ছোট মুক্তো নাড়াচাড়া করছে আর কিনোর কথা ভাবছে। কেউ মুক্তো বিক্রি করতে চাইলে, উত্তেজনা মাত্রা ছাড়ায় ব্যবসায়ীদের। খুশির সীমা থাকে না তার, সবচাইতে কমে দাঁও মারতে পারে যে। সব কজন ব্যবসায়ীই মনে মনে ঠিক করে রেখেছে কি দাম সাধবে।
হলদে সূর্যটা সেদিন সকালে তীব্র আলো বিলাচ্ছে। এক সারে সৈকতে পড়ে আছে ক্যানুগুলো, কিন্তু আজ আর ডুবুরিরা মুক্তোর খোঁজে ডুব দেয়ার নাম করছে না। কিনো মুক্তো বেচবে স্বচক্ষে দেখতে চায় তারা।
সাগরপারের কাঠের বাসাগুলোয়, অনেক সময় নিয়ে নাস্তা সারল পড়শীরা। নিজেরা অমন মুক্তো খুঁজে পেলে কি কি করবে তার জল্পনাকল্পনা চলল।
একজন বলল, মুক্তো বেচা সমস্ত টাকা সে গির্জায় দান করে দেবে।
আরেকজন জানাল, সব টাকা বিলিয়ে দেবে শহরের গরীবদের মাঝে।
পড়শীরা কামনা করছে, টাকা-পয়সা যাতে কিনোর মাথা বিগড়ে না দেয়, সে যেন আর দশজন ধনী লোকের মতন লোভী হয়ে না ওঠে। প্রতিবেশীরা সবাই তাকে ভালবাসে। কেউ চায় না মুক্তোটা তার ধ্বংস ডেকে আনুক।
কিনো একটা লক্ষ্মী বউ পেয়েছে, বলাবলি করে পড়শীরা। আর ওর বাচ্চাটাও খুব সুন্দর। ভবিষ্যতে আরও ছেলেমেয়ে হবে। আমরা চাই না মুক্তাটা ওদের সবার সর্বনাশ করুক।
কিনো আর হুয়ানার কাছে, জীবনের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ সকাল হচ্ছে আজকেরটা। কয়োটিটোকে তার সেরা পোশাকটা পরানো হয়েছে। হুয়ানা পরিপাটী করে তার চুল আঁচড়ে লাল রিবনে বেঁধেছে। তারপর প্রিয় স্কার্টটা পরেছে। কিনোর পরনের পোশাক পুরানো হলেও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। আগামীকাল, কিংবা হয়তো আজ বিকেলে, নতুন জামা-কাপড় উঠবে ওর গায়ে।
পড়শীরাও সেজেগুজে তৈরি। কিনোর দরজার দিকে লক্ষ্য তাদের। কখন বেরোবে ওরা অপেক্ষা করছে।
কিনো আর তার বউও চাইছে পড়শীরা তাদের সঙ্গে শহরে আসুক। আজকের বিশেষ এই দিনটিতে বন্ধু-বান্ধবদের পাশে চায় ওরা।
যত্নের সঙ্গে শালটা গায়ে জড়াল হুয়ানা। শালের এক কিনারে এমনভাবে জড়িয়ে নিল কয়েটিটোকে, সে যাতে বাহুর নিচে ঝোলে। কিনো ওর প্রকাণ্ড ঐ হ্যাটটা মাথায় চাপল। ওটা ঠিকঠাক মাথায় বসল কিনা দেখে নিল। অবিবাহিত লোকেদের মত মাথার পেছনদিকে কিংবা পাশে হ্যাট পরতে চায় না সে। আবার বুড়োমানুষদের মতন মাথার সঙ্গে লেপ্টে থাকুক জিনিসটা তাও পছন্দ নয়। সামনের দিকে একটুখানি ওঠানো থাকবে। হ্যাটটা, যাতে বোঝা যায় কিনো একজন শক্তিশালী যুবক। হ্যাট পরা নিয়ে লোকের কথার তো শেষ নেই।
এবার মহার্ঘ মুক্তোটা পুরানো, নরম এক পশুর চামড়ায় মুড়ে, ছোট্ট এক চামড়ার থলেয় পুরল ও। কিনোর পকেটে স্থান পেল থলেটা। বাঁ কাঁধে ভাঁজ করা কম্বলটা ফেলার পর তৈরি হলো সে যাত্রার জন্যে।
ঘরে বাইরে পা রাখল ও। হুয়ানা, কয়েটিটোকে বইছে, পিছু পিছু বেরোল। ওরা স্বামী-স্ত্রী ছোট রাস্তাটা দিয়ে শহরের উদ্দেশে পা বাড়াতে, প্রতিবেশীরা যার যার বাসা থেকে বেরিয়ে এল। ছেলে-বুড়ো সবাই আজ উৎসবের আমেজে রয়েছে। কিন্তু দিনটা যেহেতু বেজায় গুরুত্বপূর্ণ, মাত্র একজন লোক কিনোর পাশাপাশি হেঁটে চলল। এ লোক কিনোর ভাই, হুয়ান টমাস।
হুশিয়ার থাকিস, ব্যবসায়ীরা যেন ঠকাতে না পারে, বলল হুয়ান টমাস।
থাকব, জানাল কিনো।
ন্যায্য দাম কত বুঝব কি করে আমরা? জবাব চাইল হুয়ান টমাস। অন্যান্য শহরে ব্যবসায়ীরা কত টাকা সাধে জানি না তো।
তা ঠিক, বলল কিনো, কিন্তু জানবই বা কিভাবে? ওসব শহরে তো যাইনি কখনও।
তোর জন্মের আগে, কিনো, বলে ভাই, মুক্তার জন্যে বেশি দাম আদায়ের একটা বুদ্ধি আঁটে গাঁয়ের বুড়োরা। রাজধানীতে কোন লোক মারফত মুক্তা পাঠাতে পারলে, ভাল দাম পাওয়া যাবে মনে করেছিল। তারা।
জানি আমি, মাথা নেড়ে বলল কিনো। বুদ্ধিটা মন্দ ছিল না।
বুড়োরা রাজধানীতে যাওয়ার জন্যে একটা লোককে ঠিক করে, বলল হুয়ান টমাস। সমস্ত মুক্তা তার হাতে শহরে পাঠানো হয়। কিন্তু সে লোক আর ফিরে আসেনি। একই কাণ্ড আরেক লোকও যখন করল, তখন মানুষ আবার পুরনো কায়দায় ফিরে গেল।
জানি, বলল কিনো। বাবার মুখে শুনেছি। বুদ্ধিটা ভাল ছিল, কিন্তু ওটা গির্জার উপদেশের বিরুদ্ধে যায়। পাদ্রী বলেন, খোদা মানুষকে পাঠিয়েছেন দুনিয়ার খানিকটা অংশ পাহারা দিয়ে রাখার জন্যে। আমাদের উচিত নিজের নিজের জায়গা থেকে না নড়া।
হ্যাঁ, আমিও শুনেছি, বলে হুয়ান টমাস। পাদ্রী প্রতি বছরই কথাটা বলেন।
কিনো পাদ্রীর কথা অনেক বছর ধরেই মন দিয়ে শুনছে। কিন্তু পাদ্রী, ওই ডাক্তারটার মতই, অন্য গোত্রের মানুষ। যে গোত্র কিনোর পূর্বপুরুষদের রক্ত শুষে খেয়েছে কয়েকশো বছর ধরে। পাদ্রীর কথা শোনে ঠিকই কিনো, কিন্তু অন্তর থেকে লোকটাকে সে বিশ্বাস করে না।