মনটাকে শান্ত করার জন্য জাহাজের সামনে গেলাম। ওখানে তখন পাহারায় থাকার কথা হেওয়ার্ডের। দেখি আরও তিনজন নাবিকের সঙ্গে ও ঘুমিয়ে আছে। কাজে গাফিলতির জন্যে ওর ওপর আমার রেগে যাওয়া উচিত ছিল। কিন্তু আশ্চর্য, একটুও রাগ হলো না আমার। বরং একটু স্বস্তির ভাব হলে মনে। এবং তথনই কে যেন আমার কানে কানে বলে গেল কথাগুলো, ব্লাইও এখন মুমিয়ে, দখল করে মাও না জাহাজটা!
মুহূর্তে সচেতন হয়ে উঠলাম আমি। কথাটা নিয়ে কিছুক্ষণ নাড়াচাড়া করলাম মনে মনে। দ্রুত একবার চক্কর দিলাম সারা জাহাজে। বেশির ভাগ লোকই ঘুমিয়ে আছে। একমাত্র বারকিটকে দেখলাম জেগে থাকতে। বহুবার ব্লাইয়ের কাছে শাস্তি খেয়েছে ও। তাই মনে হলো ওকে হয়তো বিশ্বাস করা যায়। বারকিটের কাছে গিয়ে ফিসফিস করে বললাম, চার্চিল, মাটিন, থম্পসন আর কুইনটালকে জাগাতে পারবে অন্য কাউকে বিরক্ত না করে?
হ্যাঁ, স্যার, জবাব দিল বারকিট। কিন্তু কেন।
আমি বললাম, কারণ আছে, ওদের নিয়ে সামনের মইয়ের কাছে এসো, বলব।
বারকিটকে পাঠিয়ে দিয়ে আমি গিয়ে দাঁড়ালাম কোলম্যানের হ্যামকের কাছে। নিঃশব্দে ওকে জাগিয়ে অস্ত্রের সিন্দুকের চাবিটা চাইলাম। কারণ দেখালাম, জাহাজের আশপাশে একটা হাঙর ঘোরাঘুরি করছে, ওটা মারার জন্যে একটা মাস্কেট বের করব। কোলম্যান চাবিটা আমার হাতে দিয়ে পাশ ফিরে আবার ঘুমিয়ে পড়ল।
অস্ত্রের সিন্দুকের কাছে গিয়ে দেখি, হ্যালেট শুয়ে আছে তার ওপর। ওরও তখন কাজের সময়, ঘুমানোর কথা নয়। তাই ধমকে ওকে ডেকে পাঠিয়ে দেয়া কঠিন কিছু হলো না। বেচারা ধরা পড়ে এমন ভয় পেয়েছিল যে প্রায় উধ্বশ্বাসে ছুটে চলে গেল ডেকে। সামনের মইয়ের কাছে চলে গেলাম আমি। বারকিট এবং অন্যরা তখন পৌঁছে গেছে ওখানে। ওদের খুলে বললাম আমার পরিকল্পনার কথা-হ্যাঁ এর ভেতরে একটা পরিকল্পনা আমি খাড়া করে ফেলেছি মনে মনে। রা এক কথায় রাজি হয়ে গেল। শুধু রাজি নয়, উৎসাহে রীতিমত টগবগ করতে লাগল। অন্ত্রের সিন্দুক খুলে আমরা সবাই মাস্কেট, পিস্তল-যার যেমন পছন্দ-হাতে তুলে নিলাম। এবার ম্যাককয়, উইলিয়ামস, আলেকজান্ডার স্মিথ এবং অন্যদের জাগানো হলো। ওদেরও অস্ত্র দিলাম। কে কোথায় কি দায়িত্ব পালন করবে বুঝিয়ে দিয়ে আমি ঢুকলাম ব্লাইয়ের কেবিনে। বাকিটা তো তুমি জানো।
চুপ করল ক্রিশ্চিয়ান। আমিও চুপ।
আপনার কি মনে হয় ব্লাই ইংল্যান্ডে পৌঁছাতে পারবেন? কিছুক্ষণ পর আমি প্রশ্ন করলাম।
সম্ভাবনা কম। খুব কম। টিমোর ছাড়া সাহায্য পাওয়ার মত কোন জায়গা আশেপাশে নেই। যেখানে ওদের ছেড়েছি সেখান থেকে টিমোরের দূরত্ব কমপক্ষে বারোশো লিগ। সুতরাং বুঝতে পারছ…। আমি অবশ্য সাগরে ভাসিয়ে দিতে চাইনি। ভেবেছিলাম, বন্দী করে ওকে নিয়ে যাব ইংল্যান্ডে। কিন্তু অন্যরা রাজি হলো না-তুমি নিজেই তো দেখেছ।
আমরা যারা বিদ্রোহ করিনি অথচ কপাল দোষে বলুন আর যে কারণেই বলুন জড়িয়ে গেছি আপনাদের সাথে তাদের নিয়ে কি করবেন, ভেবেছেন কিছু।
এ প্রশ্ন যে তুমি করবে আমি জানতাম, বলে উঠে দাঁড়াল ক্রিশ্চিয়ান। পেছন দিকের একটা জানালার পর্দা তুলে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল সাগরের দিকে। তারপর আবার ঘুরল আমার দিকে।
তোমাদের যদি তাহিতিতে নিয়ে গিয়ে ছেড়ে দেই, আমি জানি, তোমরা কেউই বিদ্রোহের কথা গোপন রাখবে না। তাই দুঃখের সাথে হলেও বলতে বাধ্য হচ্ছি আমাদের সাথে থাকতে হবে তোমাদের। আপাতত এর বেশি কিছু বলতে পারছি না।
.
আটাশ মে-বিদ্রোহের ঠিক চার সপ্তাহ পর সকাল বেলা জাহাজ থেকে প্রায়, ছলিগ দূরে একটা দ্বীপ দেখতে পেলাম আমরা। সারাদিন জাহাজ চালিয়ে দ্বীপটার পশ্চিম উপকূলের মাইল তিনেকের ভেতর পৌঁছানো গেল। ওখানেই নোঙর ফেলে রাতটা অপেক্ষা করে ভোরে আবার পাল তুলে পৌঁছলাম তীরের কাছে। আমাদের স্টুয়ার্টের স্মরণশক্তি খুব তীক্ষ্ণ। কোন মানচিত্রে কোন দ্বীপের অক্ষাংশ দ্রাঘিমাংশ একবার দেখলে ভোলে না কখনও। ও ওর স্মৃতি হাতড়ে জানাল দ্বীপটার নাম টুপুয়াই। ক্যাপ্টেন কুক আবিষ্কার করেছিলেন এ দ্বীপ।
একটানা দুমাস সাগরে কাটিয়ে আমরা সবাই-কি বিদ্রোহী কি অবিদ্রোহী-তখন ডাঙায় নামার জন্যে উদগ্রীব। কিন্তু দুর্ভাগ্য, টুপুয়াইবাসীরা সে সুযোগ আমাদের দিল না। বাউন্টি তীরের কাছাকাছি হতেই ক্যানোয় চেপে এসে ওরা হামলা চালাল আমাদের ওপর। কমপক্ষে একশো হবে ক্যানোর সংখ্যা। প্রতিটায় আট থেকে দশজন করে ইন্ডিয়ান। তাদের হাতে বর্শা, লাঠি। কারও কারও হাতে দুরকমই আছে। ক্যানোগুলো বোঝাই ছোট ছোট নুড়ি পাথরে। বুঝলাম ভোরে দুর থেকে আমাদের জাহাজ দেখেই ওরা প্রস্তুত হয়েছে যুদ্ধের জন্যে।
বাউন্টি নুড়ি পাথর বা বর্শার পাল্লায় না পৌঁছানো পর্যন্ত অপেক্ষা করল ওরা। তারপর আচমকা অনেকটা হা-রে-রে-রে ধরনের শব্দ করে ছুঁড়তে শুরু করল পাথর আর বর্শা। কিছুক্ষণের ভেতর আমাদের জনা চারেক নাবিক আহত হলো। আঘাত খুব সামান্য যদিও তবু আঘাত তো। তীরের কাছ থেকে জাহাজ সরিয়ে নিলাম আমরা। কয়েকজন বিদ্রোহী কামান দাগার প্রস্তাব দিল। তা যদি করা হত সন্দেহ নেই বহু জংলী হতাহত হত, যারা বেঁচে থাকত তারা এমন আতঙ্কিত হয়ে পড়ত যে সহজেই তাদের বশ মানিয়ে আমরা এ দ্বীপে থেকে যেতে পারতাম। কিন্তু দুটোর একটাও ক্রিশ্চিয়ানের ইচ্ছা নয়।