ক্রিশ্চিয়ানের অবস্থাও আমার মত। তাহিতি ছেড়ে যেতে ইচ্ছে করছে না ওর। মাইমিতির সঙ্গে ওর সম্পর্কটা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, এখন বিচ্ছেদ দুজনের জন্যেই খুব কষ্টদায়ক হবে। এক অবস্থা মিশিপম্যান স্টুয়ার্ট, ইয়ং আর খালাসী আলেকজান্ডার স্মিথেরও। টাউরুয়া নামের এক মেয়ের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে উঠেছে ইয়ং-এর। স্টুয়ার্ট ভালবেসেছে এক গোত্রপতির মেয়েকে মেয়েটাকে ও পেগি বলে ডাকে। স্মিথের ঘনিষ্ঠতা হয়েছে চঞ্চল এক মেয়ের সাথে। তার নাম পারাহা ইটি। এই তিন জনের জন্যেও তাহিতি ছেড়ে যাওয়ার অর্থ কিছু হারানো। আমার ব্যাপারটা অবশ্য অন্য রকম। জাগতিক কিছু আমি হারাব না ঠিক, কিন্তু যা হারাব তার মূল্যও অনুভূতির বিচারে কম নয়। সহজ সরল মানুষদের এই সুন্দর দেশটাকে সত্যিই ভালবেসে ফেলেছি আমি-আরও বেশি ভালবেসেছি হিটিহিটির মত সহৃদয় বন্ধুকে।
বাউন্টি রওনা হওয়ার দিন দুই আগে ইয়ং, স্টুয়ার্ট আর স্মিথকে নিয়ে, ক্রিশ্চিয়ান এল আমার কাছে। ওদের দেখেই বুঝলাম কিছু একটা খবর আছে। ক্রিশ্চিয়ান, ইতোমধ্যে ইন্ডিয়ানদের রীতিনীতি সম্পর্কে মোটামুটি জ্ঞানার্জন, করেছে, ও জানে গুরুত্বপূর্ণ কোন খবর হুট করে জানানো পছন্দ করে না ওরা, আগে কিছু হালকা কথাবার্তা বলে নিতে হয়। তাই সে তক্ষুণি খবরটা ভাঙল না, আমার কাছে।
মাইমিতি গভীর আবেগে স্বাগত জানাল প্রেমিককে। বৃদ্ধ হিটিহিটি উঠানের ধারে চালার নিচে নিয়ে গিয়ে মাদুর পেতে বসতে দিল অতিথিদের। ভুত্যরা ডাব কেটে এনে দিল। স্টুয়ার্ট, ইয়ং আর স্মিথের বান্ধবীরাও এসে গেছে বন্ধুদের খবর পেয়ে। খেতে খেতে আলাপ করতে লাগলাম আমরা। কিছুক্ষণ পর ক্রিশ্চিয়ান মুখ তুলে তাকাল আমার দিকে।
তোমার জন্যে খবর আছে, বিয়্যাম, বলল সে। শনিবার মানে পরশু দিন আমরা রওনা হব। ব্লাই তোমাকে শুক্রবার রাতের ভেতর জাহাজে চলে যেতে বলেছে।
কথাগুলো বুঝতে পারল মাইমিতি। ভার মুখে চাইল আমার দিকে, তারপর প্রেমিকের একটা হাত তুলে নিয়ে শক্ত করে ধরে রইল।
আমার একদম যেতে ইচ্ছে করছে না, আবার বলল ক্রিশ্চিয়ান, ভালই ছিলাম এখানে।
আমারও, পেগির দিকে এক পলক তাকিয়ে যোগ করল স্টুয়ার্ট।
আমি-বাবা তোমাদের মত ছিচকাঁদুনে নই, মন্তব্য করল ইয়ং। আমি চলে গেলে নিশ্চয়ই শোকে পাথর হয়ে যাবে না টাউরুয়া। কয়েক দিন খারাপ, লাগবে, তারপর আস্তে আস্তে সব স্বাভাবিক হয়ে আসবে। হয়তো এখানকার কোন সুপুরুষ ছেলের সাথে শিগগিরই বন্ধুত্ব পাতিয়ে ফেলবে আমাকে ভোলার জন্যে।।
পাশেই বসে ছিল মেয়েটা। ভয়ানক ভাবে মাথা নেড়ে সে বোঝাতে চাইল, না, কখনও সে অমন করবে না। ক্রিশ্চিয়ান হাসল।
আমার মনে হয় ইয়ং ঠিকই বলেছে, সে বলল। মানুষের কোন দুঃখই চিরস্থায়ী নয়। দুঃখ শোক থাকে তবু মানুষ এগিয়ে যায়, মানুষের ধর্মই এই।
সন্ধ্যার সামান্য আগে ওরা ফিরে গেল জাহাজে। পরদিন সন্ধ্যায় আমিও বিদায় নিলাম হিটিহিটি ও তার পরিবারের কাছ থেকে। স্বীকার করতে লজ্জা নেই, চোখ দুটো আমার ভিজে উঠেছিল তখন, এই ভেবে যে, এই সুন্দর মানুষগুলোকে হয়তো আর কখনও দেখব না।
বাউন্টিতে ফিরে দেখি ইন্ডিয়ানে গিজ গিজ করছে জাহাজ! ডাব, নারকেল, কলা, শুয়োর, ছাগলে বোঝাই ডেক। তাহিতির মহা গোত্রপতি টেইনা আর তার স্ত্রী ইটিয়াকেও দেখলাম। ক্যাপ্টেনের অতিথি হয়ে সে রাতটা ওরা থাকল আমাদের জাহাজে। ভোরে সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে ওদের লঞ্চে করে পৌঁছে দিয়ে আসা হলো তীরে। তারপর আমরা নোঙ্গর তুলে পাল উড়িয়ে দিলাম। বাউন্টি এগিয়ে চলল খোলা সাগরের দিকে।
.
সাত
আবার আমরা সাগরে ভাসলাম।
তাহিতিকে পেছনে ফেলে যত এগিয়ে চলেছি ততই সেখানকার স্মৃতি স্বপ্নের মত লাগছে। যতক্ষণ না ছোট হতে হতে দিগন্তে বিলীন হয়ে গেল ততক্ষণ আমরা তাকিয়ে রইলাম দ্বীপটার দিকে। তারপর ধীরে ধীরে, পুরানো নিয়ম মত সবাই লেগে গেলাম যার যার কাজে।
তেইশ এপ্রিল সকালে দেখা পেলাম ফ্রেন্ডলি আর্কিপিলাগোর দ্বীপ নামুকার! ক্যাপ্টেন কুকের সঙ্গে এখানে আগে এসেছেন ব্লই। এন্ডেভার প্রণালীর দিকে আরও এগোনোর আগে এখান থেকে আমাদের কাঠ আর পানির ভাণ্ডার কিছুটা সমৃদ্ধ করে নিতে চাইলেন তিনি।
দক্ষিণ দিকে বইছে বাতাস, সে কারণে জাহাজ তীরের দিকে চালাতে বেশ বেগ পেতে হলো। নামুকা উপকূলে যখন নোঙ্গর ফেললাম তখন সন্ধ্যা হয় হয়।
দ্বীপের যে দিকটায় বাউন্টি নোঙ্গর ফেলেছে সেদিকটা পাহাড়ী, গাছপালা শূন্য; পানির উৎস, সেই সাথে লোক বসতিও, কাছাকাছি আছে বলে মনে হলো না। সুতরাং পরদিন সকালে আবার নোঙ্গর তুলতে হলো। কয়েক মাইল পুবে গিয়ে নতুন করে নোঙ্গর ফেললাম আমরা। এবার চারদিক থেকে ইন্ডিয়ানরা ঘিরে ধরল আমাদের। শুধু নামুকা নয়, আশপাশের অন্যান্য দ্বীপ থেকেও এগিয়ে আসতে লাগল ক্যানোর ঝাঁক। কিছুক্ষণের ভেতর বাউন্টির ডেকে এত ইন্ডিয়ান উঠে এল যে আমাদের কাজকর্ম সব বন্ধ হওয়ার যোগাড় হলো। অবশেষে দুজন গোত্রপতি যখন এল তখন একটু যেন শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা গেল জাহাজে। ব্লাই ওদের বোঝাতে পারলেন, ডোকের ওপর এত লোক থাকলে আমাদের পক্ষে কাজ করা অসম্ভব ইত্যাদি ইত্যাদি। এরপর পরিষ্কার হয়ে গেল ডেক। দুই গোত্রপতি কেবল রইল জাহাজে, বাকি সবাই নেমে গেল যার যার ক্যানোয়। ব্লাই এবার আমাকে ডাকলেন দোভাষীর কাজ করার জন্যে। কিন্তু দেখা গেল আমার তাহিতীয় ভাষার জ্ঞান সামান্যই কাজে আসছে। ফ্রেন্ডলি দ্বীপপুঞ্জের লোকদের ভাষার সঙ্গে বিস্তর পার্থক্য তাহিতীয় ভাষার। যাহোক ইশারা ইঙ্গিত আর কিছু কিছু শব্দ প্রয়োগে শেষ পর্যন্ত দুই গোত্রপতিকে বোঝানো গেল আমরা কি জন্যে এসেছি। চিৎকার করে দুজন কিছু নির্দেশ দিল তাদের লোকদের উদ্দেশ্যে, অমনি বেশির ভাগ ক্যানো দ্রুত তীরের দিকে এগোতে শুরু করল।