একটা কথাও না বলে পোটলাটা ছোঁ মেরে তুলে নিয়ে ধুপধাপ পা ফেলে ফোকাসলের দিকে চলে গেল এলিসন, পাখাটা রয়ে গেল হালেটের কাছে। ভয়ঙ্কর ক্রোধে গর্জে উঠতে যাব আমি, এই সময় দেখি কেরানী স্যামুয়েল আসছে। হ্যালেট ওকে থামিয়ে বলল, মিস্টার স্যামুয়েল, খানিকটা কচি শুয়োরর মাংস পেতে চান? ফোকাসূলে চলে যান। আমার সন্দেহ, এলিসনের কাছে ইন্ডিয়ান কাপড়ে মোড়া বাচ্চা শুয়োর আছে একটা।
মাথা ঝাঁকিয়ে চলে গেল স্যামুয়েল ফোকাসলের দিকে।
আমি দাঁড়িয়ে ছিলাম মাস্তুলের আড়ালে। লাফ দিয়ে বেরিয়ে এলাম এবার।
বদমাশের বাচ্চা! চিৎকার করে উঠলাম।
একটু যেন চমকাল হ্যালেট। চি চি করে বলল, আমার ওপর তুমি গোয়েন্দাগিরি করছিলে!
করতাম না, যদি না জানতাম কেমন বদস্বভাবের লোক তুমি। বলে আর দাঁড়ালাম না আমি, চলে গেলাম অন্যদিকে।
একটু পরে ক্যাপ্টেন এলেন। আমার পুঁথি পত্র নিয়ে আমি তৈরি হলাম তার সাথে সাক্ষাতের জন্যে। আধঘণ্টা পর স্লাইয়ের কামরা থেকে বেরিয়ে ডেকে এসে দেখি গ্যাঙওয়ের কাছে দাঁড়িয়ে আছে ক্রিশ্চিয়ান। সদ্য আসা একটা ক্যানো থেকে মাইমিতির পাঠানো বিপুল পরিমাণ খাবার এবং অন্যান্য জিনিস জাহাজে তুলছে। এখানে পাঠকদের অবগতির জন্যে জানিয়ে রাখা ভাল, পৈতৃক সূত্রে মাইমিত বিরাট ভূ-সম্পত্তির মালিক। ওর পক্ষে এত উপহার পাঠানে অস্বাভাবিক বা অসুবিধাজনক কিছু বয়। ও পাঠিয়েছে মোটাসোটা এক জোড় শুয়োর, বড় এক কাঁদি কলা, প্রচুর রিমাণে টারো এবং অন্যান্য শাক সবজি; এ ছাড়াও সুন্দর কয়েকটা পাটি, ইন্ডিয়ান আলখাল্লা আর এক জোড়া চমৎকার মুক্তা।
ব্লাই কেবিন থেকে বেরিয়ে গ্যায়ের কাছে আসতেই খেয়াল করলেন শুয়োর দুটো। তক্ষুণি স্যামুয়েলকে ডেকে ওগুলো জাহাজের ভাণ্ডারে নিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিলেন!
মিস্টার ব্লাই, প্রতিবাদের ভঙ্গিতে বলল ক্রিশ্চিয়ান, শুয়োর দুটো আমি আমার নিজের মেসের জন্যে রাখতে চেয়েছিলাম।
না! দৃঢ় কণ্ঠে বললেন ব্লাই। তারপর পাটি, আলখাল্লা এবং অন্য জিনিসগুলো দেখে আবার কেরানীকে বললেন, এগুলোও নিয়ে যাও, স্যামুয়েল। অন্য কোন দ্বীপে এগুলো বদলে দরকারী জিনিস পাওয়া যেতে পারে।
না, স্যার, আবার প্রতিবাদ করল ক্রিশ্চিয়ান, এগুলো ইংল্যান্ডে আমার বাড়ির লোকদের জন্যে দেয়া হয়েছে।
জবাব দেয়ার বদলে ঘুরে হাঁটতে শুরু করলেন ব্লাই। এই সময় মাইমিতির ভত্য টাপা কাপড়ে মোড়া ছোট্ট একটা পুঁটলি ক্রিশ্চিয়ানের হাতে দিতে দিতে ইন্ডিয়ান ভাষায় বলল, মুক্তা। আমার মনির ইংল্যান্ডে আপনার মায়ের জন্যে দিয়েছেন।
সঙ্গে সঙ্গে থেমে ঘুরে দাঁড়ালো ক্যাপ্টেন। কি বলল ও?-মুক্তা? দেখি, আমাকে দেখাও!
নিঃশব্দে টাপা কাপড়ের পুঁটলিটা খুলে দেখাল ক্রিশ্চিয়ান। নিখুঁত আকৃতির বড় বড় দুটো মুক্তা। বিস্ময়ের অস্কুট একটা ধ্বনি বেরোল স্যামুয়েলের গলা দিয়ে। এমন মুক্তা জীবনে দেখেনি সে। এক মুহূর্ত ইতস্তত করে ব্লাই বললেন:
স্যামুয়েলকে দাও ওদুটো। ফ্রেন্ডলি দ্বীপপুঞ্জে মুক্তার খুব কদর, অনেক জিনিস পাওয়া যাবে এগুলোর
স্যার, আমার মায়ের জন্যে দেয়া হয়েছে এগুলো, ব্লাইকে শেষ করতে দিয়ে বলল ক্রিশ্চিয়ান। সাপের মত শীতল ওর গলা।
স্যামুয়েলকে দাও ওদুটো, আবার বললেন ব্লাই।
না! অতি কষ্টে নিজেকে শান্ত রেখে জবাব দিল ক্রিশ্চিয়ান। তারপর আচমকা মুক্তা ধরা হাতটা মুঠো করে চলে গেল সে। ক্যাপ্টেনের হাত দুটো একবার মুষ্টিবদ্ধ হচ্ছে, একবার খুলছে। কেরানীর দিকে তাকালেন তিনি, যেন কিছু বলবেন। শেষ পর্যন্ত অবশ্য না বলেই চলে গেলেন তিনিও কেবিনের দিকে।
.
প্রাচুর্যের ভেতরে থেকেও মেপে মেপে খাবার দেয়া হচ্ছে নাবিকদের, স্থানীয় বন্ধুরা উপহার হিসেবে যা দিচ্ছে তা কেড়ে নেয়া হচ্ছে, তীর থেকে যখন জাহাজ আসছে প্রত্যেকের সাথে এমন ব্যবহার করা হচ্ছে যেন ওরা সবাই চোরাচালানি-এই পরিবেশে নাবিকদের মনের অবস্থা কেমন হতে পারে সহজেই অনুমেয়।
জানুয়ারির মাঝামাঝি একদিন জাহাজে গিয়ে দেখি কোয়ার্টার ডেকে অস্থির ভাবে পায়চারি করছেন এ ক্যাপ্টেন। আমাকে দেখে থেমে দাঁড়ালেন তিনি।
আজ তোমার পাণ্ডুলিপি ঘাটাঘাটি করতে পারব না, বিয়্যাম, বিরক্তির সঙ্গে বললেন ব্লাই। মুসভ্যাট আর মিলওয়ার্ডকে নিয়ে চার্চিল ভেগেছে। অকৃতজ্ঞ বদমাশের দল! একবার ধরে নেই, তারপর দেখো কেমন করে শায়েস্তা করি শয়তানগুলোকে?
খুব একটা বিস্মিত হলাম না, এমন কিছু যে ঘটবে তা যেন আমার জানাই ছিল।
ছোট কাটারটা নিয়ে গেছে বদমাশগুলো, বলে চললেন ব্লাই। আটটা বন্দুক আর কিছু গুলি বারুদের খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। একটু আগে খবর পেলাম, দ্বীপের ওপাশে এক নির্জন সৈকতে কাটার ফেলে রেখে একটা দেশী পাল তোলা ক্যানোয় চেপে টেতিয়ারোয়ার দিকে গেছে ওরা। থেমে এক মুহূর্ত কি যেন ভাবলেন ব্লাই। তারপর আচমকা জিজ্ঞেস করলেন, তোমার তাইওর একটা বড় ক্যানো আছে না?
হ্যাঁ, স্যার।
তাহলে তোমাকেই দেব বদমাশগুলোকে ধরে আনার ভার। হিটিহিটির কাছে ধার চাও ক্যানোটা; কয়েক জন লোকও চাও, আজই রওনা হয়ে যাও টেতিয়ারোয়ার দিকে। চেষ্টা করবে যেন শক্তি প্রয়োগ ছাড়াই ধরে আনতে পারে। যদি দেখ টেতিয়ারোয়ায় ওরা নেই তাহলে বাতাস অনুকূল থাকলে কালই ফিরে আসবে।