খাওয়া শেষ- এবার ঘুম, উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল হিটিহিটি।
কাছেই সৈকত। চওড়া একটা মাদুর পেতে দেয়া হলে সেখানকার একটা পুরাউ গাছের নিচে। পাশাপাশি শুয়ে পড়লাম দুজন দিবানিদ্রা দেয়ার জন্যে। তাহিতীয়দের রীতিই এই, দুপুরে ভরপেট খাওয়ার পর দিবানিদ্রা না দিলে চলে না তাদের।
.
আমার জীবনের একটা নতুন অধ্যায়ের সূচনা এইভাবে। আজ এত বছর পরেও যখন সেদিনগুলোর স্মৃতি মনে পড়ে অপূর্ব এক আনন্দে উদ্বেল হয়ে উঠি আমি। পৃথিবীর কোন চিন্তা কোন ভাবনা সে সময় আমার ছিল না, সমস্ত মন প্রাণ ঢেলে দিয়েছিলাম অভিধানের কাজে।
হিটিহিটির বাড়ির পাশ দিয়ে বয়ে গেছে সেই ছোট্ট নদী, পয়েন্ট ভেনাসে যেটা সাগরে পড়েছে। রোজ ভোরে ঘুম থেকে উঠে ওই নদীতে স্নান করে এসে ফল-মূল দিয়ে হালকা নাশতার পর কাজ শুরু করি। কাজ মানে হিটিহিটির সঙ্গে কথা বলা। বিভিন্ন শব্দ শুনে নিখুঁতভাবে লিখে নেয়ার চেষ্টা করি উচ্চারণগুলো। কোন শব্দ বুঝতে অসুবিধা হলে একাধিকবার উচ্চারণ করতে বলি। তারপর বোঝার চেষ্টা করি অর্থ। হিটিহিটি ছাড়াও এ কাজে আমাকে সাহায্য করছে ওর মেয়ে হিনা আর ভাইঝি মাইমিতি।
যতক্ষণ না মাছ ধরা ক্যানোগুলৈ সাগর থেকে ফিরে আসে ততক্ষণ অর্থাৎ এগারোটা বারোটা পর্যন্ত চলে আমার এই কাজ। এরপর রাঁধুনিরা রান্না চড়ায়। আরেকবার স্নান করে আসি আমি। এবার সাগর থেকে। এরপর হিটিহিটির। সঙ্গে দুপুরের খাওয়া এবং দিবানিদ্রা। বিকেলে ঘুম থেকে উঠে হিটিহিটি বা তার পরিবারের অন্য কোন সদস্যের সাথে বেড়াতে বেরোই। কখনও সাগর পাড়ে, কখনও পাহাড়ে, কখনও বা ওদের কোন আত্মীয় বা বন্ধুর বাসায় যাই। সন্ধ্যার পর একে একে জ্বলে ওঠে ক্যান্ডল নাটের প্রদীপ। বিরাট মাদুরে বসে গল্প করি হিটিহিটির পরিবারের সদস্যদের সাথে। যতক্ষণ না একে একে সবাই ঘুমিয়ে পড়ে ততক্ষণ চলে গল্প।
ওদের বাড়িতে প্রথম যেদিন পৌঁছুলাম সেদিন বিকেলে, দিবানিদ্রার পর ঘরে ফিরে আমার জাহাজী সিন্দুকটা খুললাম। পরিবারের প্রতিটি সদস্য ঘিরে দাঁড়িয়েছে আমাকে। অপার কৌতূহল আর বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে আছে। সিন্দুকটা যেন যাদুর বাক্স। রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করছে ওরা ভেতর থেকে কি বের হয় দেখার জন্যে। একে একে বের করলাম আমি কেতি, বড়শি, কাঁচি, ছোট ছুরি; মেয়েদের চুড়ি, হার, কানের দুল ইত্যাদি ইত্যাদি। হিটিহিটির পরিবারের প্রত্যেককে-যার জন্যে যেটা উপযোগী বুঝে দিলাম কিছু না কিছু। কি খুশি যে ওরা হলো-একেবারে বাচ্চা থেকে নিয়ে হিনা, মাইমিতি এমন কি হিটিহিটি পর্যন্ত-ভাষায় প্রকাশ করতুে পারব না। কিছুদিন যেতে না যেতে অবশ্য বুঝেছিলাম হিটিহিটির মত ইন্ডিয়ানের বন্ধুত্ব অর্জন করার জিনিস। এ জিনিস কেনা যায় না, সে যত মূল্যই দিতে চাই না কেন। ও, ওর মেয়ে আর ভাস্তি আন্তরিক ভাবে পছন্দ করে আমাকে। নানাভাবে তার প্রমাণ পেয়েছি। আমি নিশ্চয়ই আমার কলম, কালি, কাগজ আর অসংখ্য প্রশ্ন নিয়ে এটা আপদ বিশেষ ওদের কাছে; কিন্তু কখনও বিরক্ত হতে দেখিনি একজনকেও। অসীম ধৈর্যের সাথে ওরা শোনে আমার প্রশ্ন, সাধ্যমত উত্তর দিয়ে যায়। কখনও কখনও মাইমিতি বা হিনা কপট হতাশার ভঙ্গিতে দুহাত ছড়িয়ে দিয়ে হাসতে হাসতে বলে, হয়েছে, হয়েছে, এবার শেষ করো, বিয়্যাম, আমার মাথায় আর কিছু আসছে না! বা হিটিহিটি ঘন্টা খানেক একটানা আমার প্রশ্নের জবাব দেয়ার পর বলে, এবার চলো ঘুমাই, বিয়্যাম! এক দিনে এত চিন্তা ভাবনা করলে নিশ্চয়ই তোমার-সেই সাথে আমারও মাথা বিগড়ে যাবে! কিন্তু পরদিন সকালে দেখি আবার ওরা তৈরি আমাকে সাহায্য করার জন্যে।
প্রতি রোববার আমি আমার অভিধানের পাণ্ডুলিপি বগলদাবা করে বাউন্টিতে গিয়ে উঠি। মিস্টার ব্লাইকে জানাই আমার কাজের অগ্রগতি। গভীর আগ্রহ নিয়ে আমার কথা শোনেন ব্লাই। পাণ্ডুলিপিটা উল্টে পাল্টে দেখেন। তারপর নিজের কাজ কদ্দূর এগিয়েছে সে সম্পর্কে বলেন দুচার কথা। হিটিহিটির বাড়ি থেকে প্রথম যে রবিবার বাউন্টিতে গেলাম সেদিন জানতে পারলাম, তীরে মিষ্টার ব্লাই-এর নির্দেশে বিরাট এক তাঁবু খাটানো হয়েছে। উদ্ভিদ বিজ্ঞানী নেলসন আর তার সহকারী ব্রাউন এখন সেখানেই থাকেন। রুটিফলের চারা সংগ্রহ এবং পরিচর্যার জন্যে সাতজন লোক দেয়া হয়েছে ওদের অধীনে। আমার মত নেলসনও দুতিন দিন পর পর জাহাজে গিয়ে ক্যাপ্টেনকে জানিয়ে আসেন অগ্রগতির খবর।
রুটিফলের চারার খোঁজে রোজ দ্বীপের এখানে ওখানে ঘুরতে হয় নেলসনকে। দ্বীপের সব গোত্রপতি তাদের প্রজাদের নির্দেশ দিয়ে রেখেছে, নেলসন যখন যা চাইবেন যেন দেয়া হয় তাকে। অদ্ভুত এক কৌশল খাঁটিয়ে ব্যাপারটা সম্ভব করেছেন ব্লাই। মাতাভাই এ নোঙ্গর ফেলার দুতিন দিন পর এক সকালে তাহিতির সব গোত্রপতিকে বাউন্টিতে নিমন্ত্রণ করেছিলেন তিনি। সবাইকে প্রচুর পরিমাণে উপহার-বেশির ভাগই আমি যে সব জিনিস হিটিহিটির পরিবারের সদস্যদের দিয়েছি সে ধরনের-দিয়ে ব্লাই বলেছিলেন, এসব উপহার তাদের জন্যে শুভেচ্ছার নিদর্শনস্বরূপ পাঠিয়েছেন ইংল্যান্ডের রাজা জর্জ। তারপর তিনি সবিনয়ে জানিয়েছিলেন তার আসার কারণ। শুনে এক সাথে লাফিয়ে উঠছিল সব কজন গোত্রপতি। এত সহজে রাজা জর্জকে খুশি করা যাবে যেন ভাবতেই পারেনি তারা। বলেছিল, যে মূল্যবান উপহার আমাদের জন্যে পাঠিয়েছেন রাজা জর্জ তার বিনিময়ে যা চেয়েছেন সে অতি সামান্য। যত খুশি রুটিফলের চারা তুমি নিতে পারো, পারাই।