রুকু – ২
২০। তোমার প্রভু জানেন, যে তুমি কখনও রাতের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ, কখনও অর্দ্ধেক এবং কখনও রাতের এক তৃতীয়াংশ নামাজে দাঁড়িয়ে থাক ৫৭৭১, এবং যারা তোমার সাথে আছে তাদের একদলও [ দাঁড়িয়ে থাকে ]। কিন্তু আল্লাহ্-ই রাত্রি ও দিনকে উপযুক্ত পরিমাণে করেছেন। তিনি জানেন যে, তোমরা ইহা পুরোপুরি পালন করতে পারবে না ৫৭৭২। সুতারাং তিনি তোমাদের প্রতি দয়াপরবশ হয়েছেন কাজেই কুর-আনের যতটুকু আবৃত্তি করা সহজ, ততটুকু আবৃত্তি কর ৫৭৭৩। তিনি জানেন যে, তোমাদের মধ্যে কেহ কেহ অসুস্থ থাকবে, কেহ কেহ আল্লাহ্র অনুগ্রহ সন্ধানে দেশ ভ্রমণ করবে এবং কেহ কেহ আল্লাহ্র পথে সংগ্রামে লিপ্ত থাকবে ৫৭৭৪। কাজেই তোমরা কুর-আন থেকে যতটুকু সহজবোধ্য ততটুকু আবৃত্তি কর। এবং নিয়মিত নামাজ প্রতিষ্ঠা কর, এবং যাকাত প্রদান কর। এবং আল্লাহকে উত্তম ঋণ প্রদান কর ৫৭৭৫। তোমাদের আত্মার [ কল্যাণের ] জন্য ৫৭৭৬ যা কিছু ভালো কাজ অগ্রে প্রেরণ করবে, তোমরা তা আল্লাহ্র নিকটে পাবে। হ্যাঁ, তা হবে উৎকৃষ্টতর এবং পুরষ্কার হিসেবে মহত্তর। আল্লাহ্র করুণা ভিক্ষা কর। নিশ্চয়ই আল্লাহ্ বারে বারে ক্ষমাশীল, পরম করুণাময়। ৫৭৭৭
৫৭৭১। দেখুন পূর্বের আয়াত [ ৭৩ : ২ – ৪ ]। রাসুল (সা) ও তাঁর একান্ত অনুগত অনুসারীবৃন্দ অনেক সময়েই রাত্রির ঘুম ত্যাগ করে রাত্রির দুই তৃতীয়াংশ, অথবা অর্ধাংশ বা এক তৃতীয়াংশ প্রার্থনা এবং কোরাণ তেলাওয়াতে ব্যয় করতেন। অধিকাংশ রাত্রি তাহাজ্জুতের নামাজে ব্যয় করার দরুণ তাদের পদদ্বয় ফুলে যেতো এবং আদেশটি কষ্টসাধ্য প্রতীয়মান হয়। পূর্ণ এক বছর পর এই সূরার শেষাংশ অবতীর্ণ হলে দীর্ঘক্ষণ নামাজে দন্ডায়মান থাকার বাধ্যবাধকতা রহিত হয়ে যায়। যতক্ষণ নামাজ পড়া সহজ মনে হয়, ততক্ষণ নামাজ পড়াই তাহাজ্জুদের জন্য যথেষ্ট। কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, যারা অসুস্থ, বা কেহ কার্য উপলক্ষে বিদেশে অবস্থান করলে বা কেহ আল্লাহ্র রাস্তায় সংগ্রামে ব্যস্ত থাকলে তাদের জন্য দীর্ঘক্ষণ তাহাজ্জুদের নামাজ পড়া কষ্টসাধ্য ব্যাপার। সুতারাং তাহাজ্জুদের নামাজকে ‘ফরজ’ নামাজ না করে ব্যক্তির ইচ্ছার উপরে ন্যস্ত করা হয়।
৫৭৭২। ” তিনি জানেন যে তোমরা ইহা পুরোপুরি পালন করতে পারবে না।” আক্ষরিক অর্থে বলা যায় যে সাধারণ মানুষের পক্ষে রাত্রির বিভিন্ন অংশের সঠিক হিসাব রাখা সম্ভব নয়। কারণ দিন ও রাত্রির দৈর্ঘ্য বৎসরের বিভিন্ন সময়ে দিন ও রাত্রির হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটে। এই হ্রাস-বৃদ্ধির সঠিক হিসাব রাখা শুধুমাত্র জ্যোতির্বিদদের পক্ষেই সম্ভব, যা সাধারণ মানুষের পক্ষে অসম্ভব ব্যাপার। সুতারাং আল্লাহ্ তা রহিত করে দেন। কিন্তু মওলানা ইউসুফ আলী মনে করেন আয়াতটির অর্থ অত্যন্ত ব্যপক ও গভীর। আল্লাহ্ দিন ও রাত্রিকে সৃষ্টি করেছেন, কাজ ও বিশ্রামের জন্য, যদিও ঋতু চক্রের বিভিন্ন সময়ে দিন ও রাত্রির হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটে থাকে। নামাজ ও প্রার্থনার জন্য রাত্রির ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র পরিবর্তন লক্ষ্য করার প্রয়োজন নাই বা তা করা সম্ভবও নয়। আল্লাহ্র এবাদত বহুভাবেই করা সম্ভব যার বর্ণনা নিম্নে করা হয়েছে। কিন্তু শর্ত হচ্ছে আল্লাহ্র এবাদতের জন্য আমরা কিছুটা সময় ব্যয় করবো যা হবে আন্তরিক এবং আল্লাহ্র প্রতি একান্তভাবে অনুগত এবং সে সময়টি ব্যয় করা আমাদের জন্য হবে সহজ,সুবিধাজনক এবং বিভিন্ন পরিবেশগত সময়ে যেমন স্বাস্থ্যগত কারণে, দেশভ্রমণের সময়ে, বা বিভিন্ন কর্তব্য কর্মে লিপ্ত থাকার সময়ে সে সময় ব্যয় করা মানুষের পক্ষে দুঃসহ বলে মনে না হয়।
৫৭৭৩। ততটুকু আবৃত্তি কর।” কোরাণ পাঠ ধর্মীয় এবাদতের এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এই পাঠ যেনো হয় আনন্দদায়ক, সহজ এবং আনুগত্যের মাধ্যমে। দেখুন সূরা [ ২০ : ২ ] আয়াত যেখানে বলা হয়েছে, ” আপনাকে ক্লেশ দেবার জন্য আমি আপনার প্রতি কোরাণ অবতীর্ণ করি নাই।” সুতারাং কোরাণ পাঠ করতে হবে অর্থ বুঝে, আন্তরিক ভাবে,গভীর আবেগে, একাগ্রভাবে যেনো কোরাণের বাণীর উপদেশ বা হেদায়েত গ্রহণের ক্ষমতা আত্মার মাঝে জন্ম গ্রহণ করে এবং এই বাণীর পরশে হৃদয় হয় আপ্লুত, আলোকিত ও পুলকিত। অর্থ না বুঝে যান্ত্রিক ভাবে শুধুমাত্র আরবী ভাষাতে কোরাণ পাঠে আত্মার মাঝে এই অনুভব লাভ সম্ভব নয়।
৫৭৭৪। ” জিহাদ বা আল্লাহ্র পথে সংগ্রাম ” অধিকাংশের মতামত হচ্ছে যে সূরাটির এই অংশ মুল সূরা অবতীর্ণ হওয়ার বহু পরে মদিনাতে অবতীর্ণ হয়। এই অংশে আনুশাসনিকভাবে সালাত কায়েম করা, যাকাত প্রদান করা এবং আল্লাহকে উত্তম ঋণ প্রদান করার কথা বলা হয়েছে যার থেকে দৃঢ় প্রত্যয় জন্মে সূরাটির এই অংশ মূল সূরার বহু পরে অবতীর্ণ হয়।
৫৭৭৫। দেখুন অনুরূপ আয়াত [ ২ : ২৪৫ ] ও টিকা ২৭৬ যেখানে উত্তম ঋণের অংশটির ব্যাখ্যা প্রদান করা হয়েছে। আরও দেখুন সূরা [ ৫৭ : ১৮ ] আয়াত। ” উত্তম ঋণ ” একটি প্রতীক ধর্মী বাক্য। এই বাক্যটি দ্বারা বুঝানো হয়েছে আল্লাহ্র রাস্তায় কাজ বা আল্লাহ্র সন্তুষ্টিলাভের জন্য কাজ করা। আল্লাহকে উত্তম ঋণ দিতে হবে আমাদেরই আত্মিক কল্যাণের জন্য। আল্লাহ্র তাতে কোনও লাভ নাই। এই ঋণের পরিবর্তে আমরা আল্লাহ্র নিকট থেকে পার্থিব বস্তু পুরষ্কার হিসেবে কামনা করতে পারি না। আল্লাহ্ আমাদের যা পুরষ্কার দিবেন তা হবে পার্থিব বস্তু থেকে বহুগুণে শ্রেষ্ঠ ও উন্নত। বাইবেলের ভাষ্য অনুযায়ী, “Hay up for yourselves treasures in heaven.” [ Matt vi 20]।