২৯। মুহম্মদ আল্লাহ্র রাসুল ; তাঁর সাথে যারা আছে তারা অবিশ্বাসীদের প্রতি কঠোর, [ কিন্তু ] পরস্পরের প্রতি সহানুভূতি সম্পন্ন ৪৯১৩। আল্লাহ্র অনুগ্রহ ও সন্তুষ্টি কামনায় তুমি তাদের রুকু ও সেজদায় অবনত হতে দেখবে ৪৯১৪। তাদের মুখমন্ডলে সিজ্দার প্রভাব পরিস্ফুট থাকবে ৪৯১৫। তাওরাতে এদের উপমা এরূপ ৪৯১৬ এবং ইঞ্জিলেও এদের উপমা হচ্ছে এরূপ ৪৯১৭: যেনো [ ছোট্ট ] বীজ যা দুটি পত্রফলক বের করে ; তার পরে তা শক্ত হয়, এর পরে তা মজবুত হয় ও কান্ডের উপরে দাঁড়ায়, যা [ চাষীকে ] বিস্ময় ও আনন্দ বর্ষণ করে। এভাবেই আল্লাহ্ [ মুমিনদের সমৃদ্ধি দ্বারা ] অবিশ্বাসীদের হৃদয় আক্রোশে পূর্ণ করেন। যারা ঈমান আনে ও সৎ কাজ করে আল্লাহ্ তাদের ক্ষমার ও মহাপুরষ্কারের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন।
৪৯১৩। দেখুন অনুরূপ আয়াত [ ৯ : ১২৮ ]। রাসুলের সহচরগণ হচ্ছেন আল্লাহ্র প্রতি একান্ত নিবেদিত মোমেন বান্দা। তাঁরা কাফেরদের প্রতি বা যারা আল্লাহ্র আইন অমান্যকারীদের প্রতি কঠোর, অপরপক্ষে নিজ সম্প্রদায় যারা মোমেন বা আল্লাহ্র অনুসারী, তাদের প্রতি ভ্রাতৃসম এবং দুর্বল ও অত্যাচারীতদের প্রতি ভাতৃসম সৌহার্দ্যপূর্ণ। তাঁদের সাহায্য ও সহযোগীতার জন্য এ সব আল্লাহ্ ভক্তদের হস্ত সর্বদা সম্প্রসারিত হয়। আল্লাহ্ ভক্তদের গুণাবলী সংক্ষেপে এই আয়াতের মাধ্যমে বর্ণনা করা হয়েছে।
৪৯১৪। আল্লাহ্ ভক্তদের আরও গুণাবলী বর্ণনা প্রসঙ্গে বলা হয়েছে যে এরা হবেন বিনয়ী – আল্লাহ্ ও রাসুলের আনুগত্যে তারা সর্বদা বিনয়াবনত। তারা পার্থিব ক্ষমতা, জাঁকজমক, অথবা চাকচিক্যের নিকট অবনত হন না। তাদের আনুগত্য ও বিনয় হবে শুধুমাত্র আল্লাহ্র সন্তুষ্টি লাভের জন্য। জাগতিক কোনও সুযোগ, সুবিধা বা পার্থিব সম্মান তাঁদের কাম্য নয়। ”আল্লাহ্র সন্তুষ্টি কামনায় তুমি তাদের রুকু সেজদায় অবনত হতে দেখবে।”
৪৯১৫। আল্লাহ্র প্রতি তাঁদের এই ভালোবাসা তারা বাইরের পৃথিবীতে প্রদর্শন করতে না চাইলেও তাদের সমস্ত অবয়বে তা পরিষ্ফুট হয়ে পড়ে। কারণ আল্লাহ্র প্রতি এই ভালোবাসাতে তাদের হৃদয় মন হয়ে পড়ে আপ্লুত, যার বহিঃপ্রকাশ ঘটে তাদের মুখমন্ডলে। মুখমন্ডল হচ্ছে প্রতিটি ব্যক্তির অন্তরের বহিঃপ্রকাশের অঙ্গ। “মুখমন্ডলে সিজ্দার চিহ্ন দেখিবে” এই বাক্যটিকে যদি আক্ষরিক অর্থে গ্রহণ করা হয় তবে এর অর্থ দাঁড়ায় পুণঃপুণঃ সেজ্দা করার ফলে তাঁদের কপালে সেজদার চিহ্ন অঙ্কিত হয়ে পড়ে। প্রকৃতপক্ষে সেটাই শেষ কথা নয়। একজন ভালো, সৎ ও পূণ্যবান ব্যক্তির চেহারা, আচার-আচরণ, কথা-বার্তা, ইত্যাদির মাধ্যমে তার অন্তরের যে দীপ্তি, যা আল্লাহ্ কর্তৃক প্রদত্ত তা প্রস্ফুটিত হয়ে পড়ে। তিনি হবেন ভদ্র, দয়ালু, ক্ষমাশীল, সাহায্যকারী, সৎ ও সর্বপরি সর্ববিষয়ে আল্লাহ্র প্রতি নির্ভরশীল। এদের অন্তরে আল্লাহ্ প্রশান্তি প্রদান করেন। [ Sakina ৪৮ : ২৬ আয়াত ] যার বহিঃপ্রকাশ ঘটে তাদের মুখমন্ডলে ও সর্ব অবয়বে। এই মানসিক প্রশান্তি একমাত্র আল্লাহ্ ব্যতীত পৃথিবীর অন্য কোন শক্তি দান করার ক্ষমতা রাখে না।
৪৯১৬। ‘তওরাত’ হচ্ছে হযরত মুসার দেয় আল্লাহ্র কিতাব – যা বর্তমানে অবিকৃত অবস্থায় নাই। বর্তমান গ্রন্থ ‘Pentatench’ হচ্ছে হযরত মুসার কিতাবের বিকৃত অংশ বিশেষ। তওরাতে সিজ্দাকে বর্ণনা করা হয়েছে বিনয় প্রকাশের সর্বোচ্চ মাধ্যম হিসেবে। সেখানে বলা হয়েছে, “Moses and Aron fell upon their faces ” [ Num xvi 22 ]।
৪৯১৭। “ইঞ্জিল ” – খৃষ্টানদের ধর্মগ্রন্থ। এই গ্রন্থে বীজের উপমাকে ব্যবহার করা হয়েছে। কি ভাবে ভালো বীজ থেকে ভালো ফসল উৎপন্ন হয় যা বপনকারীর ধারণারও বাইরে। বর্ণনাটি এরূপ,”The seed should spring and grow up, he knoweth not how; for the earth bringeth forth fruit of herself : first the blade, then the ear , after that the full corn in the ear .” [ Mark iv 27 -28 ] । রাসুল ( সা ) কর্তৃক ইসলামের প্রচার ও প্রসার ছিলো ঠিক উপরের ঐ বর্ণনার ন্যায়। ক্ষুদ্র বীজ যখন বপন করা হয়; মনে হয় তা মাটির অভ্যন্তরে হারিয়ে গেছে। দৃষ্টিতে তা আর ভাস্বর হয় না। কিন্তু মাটির অভ্যন্তরে বীজ হয়ে ওঠে সজীব – একদিন তা অঙ্কুরিত হয়, ধীরে ধীরে বড় হয় ; শক্ত মজবুত হয়ে নিজ কান্ডের উপরে দৃঢ় ভিত্তিতে দাড়িয়ে পড়ে এবং একদিন মহীরূহুতে পরিণত হয়। তখন একজন অন্ধ ব্যক্তিও তার অস্তিত্বকে অস্বীকার করতে পারে না। ইসলামের প্রচার ও প্রসার এবং মুমিনদের উপমা হচ্ছে মহীরূহু এর বীজের ন্যায়। কোরাণের বর্ণনায় উপমাটির খুঁটিনাটি জীবন্তভাবে তুলে ধরা হয়েছে। বীজ বপনকারী চাষীর মানসিক আনন্দকে তুলে ধরা হয়েছে নিম্নের বাক্যটি দ্বারা : “তার পরে তা শক্ত হয়, এর পরে তা মজবুত হয় ও কান্ডের উপরে দাঁড়ায়, যা চাষীকে বিস্ময় ও আনন্দ বর্ষণ করে” সেরূপ সৎ কাজ বা ভালো কাজ সর্বদা আল্লাহ্র সাহায্যপুষ্ট হয় এবং খুব ক্ষুদ্র পরিসরে তার প্রথম প্রকাশ ঘটে ঐ বীজের অঙ্কুরোদগমের ন্যায় – অনেক সময়ে যা দৃষ্টিগোচর হয় না। যদি সৎ কাজের নিয়ত বা উদ্দেশ্য হয় আল্লাহ্র সন্তুষ্টি লাভের জন্য তবে তা আল্লাহ্র রহমতে ধন্য হয়ে বিস্তার লাভ করবে এবং বীজ থেকে উদ্গত ছোট চারা গাছের মহীরূহুতে পরিণত হওয়ার ন্যায় একদিন তা বিশাল প্রতিষ্ঠানে পরিণত হতে বাধ্য।